Read Time:16 Minute, 6 Second

ফিরোজ মাহবুব কামাল :

ব্যর্থতা ইতিহাস তুলে ধরায়

ইসলামের শত্রুপক্ষ বিজয়ী হলে বিচার-আচারের মানদন্ডটিও তাদের অনুকুলে পাল্টে দেয়া হয়। তখন সে মানদন্ডে ইসলামের ভয়ানক শত্রু এবং কাফের শক্তির সেবাদাসও বন্ধু ও পিতা রূপে চিত্রিত হয়। সে সাথে ইসলামের পক্ষের শক্তি চিত্রিত হয় ভিলেন রূপে। মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাদের চরিত্রহরণ করা হয় এবং তাদের ফাঁসিতেও চড়ানো হয়। সেটি যেমন নমরুদ-ফিরাউনের আমলে হয়েছে, তেমনি হচ্ছে বাংলাদেশেও। এমন এক বিকৃত মানদন্ড প্রতিষ্ঠা দিয়ে শেখ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারি বাকশালীকে এবং তার দুর্বৃত্ত সাথীদেরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। সে সাথে বন্ধু দেশ রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে ভারতকে। অপরদিকে যারা ইসলামি ব্যক্তিত্ব তাদের চরিত্র হরণ করা হয়েছে নানা রূপ মিথ্যা অপবাদ দিয়ে।

একাত্তরের ঘটনাবলিকে জনগণের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইসলামপন্থিদের ব্যর্থতাটি বিশাল। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরাটি মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা সে বিশাল ইতিহাস তুলে ধরেছেন বলেই ফিরাউন, নমরুদ, কারুণের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ  ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি। মানব ইতিহাসে তারা হাজার হাজার বছর বেঁচে আছে মানুষের ঘৃণা ও অভিশাপ নিয়ে এবং নিজ নিজ অপরাধ কর্মগুলির শিক্ষ্যণীয় বিবরণ নিয়ে। অপর দিকে মানব জাতির জন্য অনুকরণীয় শ্রেষ্ঠ চরিত্র রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং অন্যান্য নবীগণ। ইসলামের পক্ষের শক্তির পক্ষ থেকে তেমন একটি মূল্যায়ন একাত্তর নিয়েও হওয়া জরুরী ছিল।

এটি সত্য যে, একাত্তরে ইসলামের পক্ষের শক্তি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়টি হয়েছে একাত্তরের পর। এবং সেটি নৈতিক, আদর্শিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়। তারা পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে একাত্তরের সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে। কেন তারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিল -সে সত্যটি তারা আজও তুলে ধরেনি। একাত্তরে যে দলগুলি পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নিয়েছিল তারা হলো আওয়ামী লীগ, চীনপন্থি ও মস্কোপন্থি ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি এবং হিন্দুগণ। এদের ভোট সংখ্যা আজ ৩৫% ভাগের বেশী নয়। অপর দিকে যারা অখন্ড পাকিস্তান বাঁচানোর পক্ষ নিয়েছিল তারা হলো মুসলিম লীগের তিনটি উপদল, জনাব নুরুল আমীনের পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং সকল আলেম সম্প্রদায় ও পীরগণ। এদের বিশাল গণভিত্তি ছিল। সেটি শেখ মুজিব জানতো বলেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির নামে রেফেরেন্ডামের দাবী কখনোই করেনি। রেফেরেন্ডাম হলে পাকিস্তানপন্থিদের ভোট ৫-৬ দলের মাঝে বিভক্ত হতো না। তখন ভোট ভাগ হতো দুই ভাগে। শেখ মুজিব স্বাধীনতার দাবী তুলেছে ৬ দফার নামে ভোট নেয়ার পর।  ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধী ছিল এমন বহু লোক তার দলকে ভোট দিয়েছে। এটি ছিল জনগণের সাথে মুজিবের বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ জনগণ কখনোই তাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ম্যান্ডেট দেয়নি।

একাত্তরে নেজামে ইসলাম একটি বৃহৎ দল ছিল। পঞ্চাশের দশকের এ দলের নেতা চৌধুরী মহম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয় পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান। দলটির আরেক নেতা কক্সবাজারের মৌলভী ফরিদ আহমেদ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন। জামায়াত নেতা জনাব গোলাম আযম লিখেছেন পিস কমিটি বানানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উদ্যোগী ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমেদ। আজকের হিফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা শফির ওস্তাদ মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ সাহেব ছিলেন একাত্তরে নেজামে ইসলাম দলের প্রবীন নেতা। সত্তরের দশকে মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ সাহেব ছিলেন হাট হাজারী মাদ্রাসার প্রধান। পাকিস্তানের অখন্ডতা বাঁচানোর কাজে এ দলটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অথচ এ দলের নেতাগণও তাদের সে ভূমিকা নিয়ে আজ নিশ্চুপ। যেন তারা কিছুই জানে না। ফলে চরিত্র হনন হচ্ছে তাদেরও। তাদের নীরবতাটি বরং ইসলামের শত্রুদের জন্য চরিত্র হননের কাজটি আরো সহজ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সত্য বলা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তাদের অনেকে ইসলামের শত্রুদের সাথে মিতালী গড়ে তাদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ও কদর বৃদ্ধিরও চেষ্টা করছেন। এ কাজে তাদেরকে শেখ হাসিনার পাশেও দেখা যায়। তাদের অনেকে হাসিনার ন্যায় এক দুর্বৃত্ত ভোট-ডাকাতকে ‘কওমী জননী’র খেতাবও দিয়েছে। নৈতীক দিক দিয়ে নীচের নামার এটি এক বিরল দৃষ্টান্ত।

ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একাত্তরে ইসলামের পক্ষের শক্তিগুলির যে গৌরবময় ভূমিকা ছিল -সেটিকে তারা নিজেরাই নিজেদের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত করেছে। এদিক দিয়ে  জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের ভূমিকাটি অতি বিস্ময়কর। ‌বিজয় দিবসের নামে ১৬ ডিসেম্বরে  তারা যেরূপ বিজয় মিছিল বের করে -সেরূপ মিছিল একাত্তরের যারা প্রকৃত বিজয়ী তারাও করে না। অথচ কে না জানে, ‌১৬ ডিসেম্বরে বিজয়টি ইসলামের পক্ষের শক্তির ছিল না। সে বিজয় ছিল ভারত ও তার সেবাদাসদের। এ দিনটি ছিল বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাতমের দিন। যাদের মনে সামান্যতম ঈমান আছে তারা কি কোন মুসলিম দেশ ভেঙ্গে যাওয়াতে খুশি হতে পারে? এ দিনে সে বিজয় মিছিলই বা বের করবে কোন আনন্দে? সে দেশটি পাকিস্তান না হয়ে যদি সূদান, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক বা অন্য যে কোন মুসলিম দেশ হতো -তবু্ও তো সেটি মাতমের দিন রূপে গণ্য হতো।

জিহাদ চাই বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে

মুসলিমদের ব্যর্থতা শুধু বন্ধুদের চেনায় নয়, শত্রুদের চেনাতেও। এরূপ ব্যর্থতার কারণে মুসলিম উম্মাহর মাঝে একতার চেয়ে বিভক্তিই শ্রেয় গণ্য হয়েছে। এর ফলে শত্রুগণ যেমন নেতা বা পিতা রূপে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনি বন্ধুগণ চিহ্নিত হয়েছে শত্রু রূপে। অথচ শত্রু-মিত্র চেনার এ ব্যর্থতাটিই ব্যক্তির সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা। এরূপ অযোগ্যতায় মহান সৃষ্টিকর্তাকে চেনাও অসম্ভব হয়। ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ তখন জনগণের কাছে ভগবান, নেতা, পিতা বা প্রধানমন্ত্রী রূপে গৃহিত হয়। শাপ-শকুন, গরু-বাছুর, মুর্তি ভগবানের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছে তো মানুষের সে বোধহীনতার কারণে। এক্ষেত্রে বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতাটি বিশাল।

একটি জনগোষ্ঠি কতটা জাহান্নামী -সেটি বুঝা যায় কাকে তারা ভগবান বলে মান্যতা দেয় বা পূজা দেয় তা থেকে। তেমনি একটি দেশের মানুষ কতটা অযোগ্য, অশিক্ষিত বা বোধশূণ্য সেটি বুঝা যায় সেদেশে কীরূপ মানুষ জাতির পিতা, নেতা বা শাসক রূপে গৃহীত হয় -তা দেখে। যেদেশে শেখ মুজিবের ন্যায় একজন গণহত্যাকারি বাকশালী ফ্যাসিস্টকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতার আসনে বসানো হয় বা শেখ হাসিনার ন্যায় নৈশকালীন ভোট-ডাকাতকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয় –সে দেশের মানুষকে কি সুসভ্য, সুশিক্ষিত ও বিবেকবান বলা যায়? গণতন্ত্রের এরূপ শত্রুদেরকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা জার্মানীর ন্যায় দেশে রাজনীতি করতে দেয়া দূরে থাক, বাঁচার অধিকার দিত? অথচ বাংলাদেশে এ দুর্বৃত্তগণই ছিল একাত্তরের নেতা এবং আজ দেশ তাদের হাতেই অধিকৃত।  

জীবনে বাঁচাটি নিরাপদ করতে হলে শুধু বিষাক্ত শাপ ও হিংস্র পশুকে চিনলে চলে না; মানবরূপী দুর্বৃত্তদেরও চিনতে হয়। সে সামান্য সামর্থ্যটুকু না থাকলে অসম্ভব হয় মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর দ্বীন ও তাঁর প্রিয় রাসূলকে চেনা। অসম্ভব হয় সমাজের সভ্য মানুষদের চেনা। অথচ এটিই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এমন ব্যর্থতা ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়। শাপ যে প্রাণনাশী -সেটি জানা যায় শাপের দংশনে কারো মৃত্যু দেখে। তেমনি দুর্বৃত্ত নেতাদের চেনা যায় তাদের হাতে জনগণের প্রাণনাশ, ক্ষয়-ক্ষতি ও মুসলিম উম্মাহ দুর্বল হওয়া দেখে। তাই যারা ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে মুসলিম উম্মাহর দেহকে খণ্ডিত করে -তাদেরকে কি কখনো বন্ধু বা নেতা বলা যায়? অথচ বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে।

বাংলাদেশে যারা ইসলামের পক্ষের আলেম, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী তাদের জন্য যে কাজটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, জনগণের মনকে কোর’আন-হাদীস ও ইতিহাসের জ্ঞানে আলোকিত করা। নইলে অন্ধকার নিয়ে কে শত্রু এবং কে মিত্র সেটি চেনার কাজ কখনোই সঠিক হয় না। বিশেষ করে সেটি একাত্তর প্রসঙ্গে। এটি এক বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। নইলে রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামের শত্রু ও ভারতেসেবী মীর জাফরদের বিরুদ্ধে যে জিহাদ চলছে তাতে  বিজয়ী হওয়া অসম্ভব হবে। এক্ষেত্রে ইসলামপন্থিদের ব্যর্থটি বিশাল। এটি যে চরম ব্যর্থতা -সে ধারণাও তাদের নাই। এ ব্যর্থতার কারণেই কাফের শক্তির সেবাদাসগণ যেমন নেতা গণ্য হচ্ছে, তেমনি ইসলামপন্থি ব্যক্তিগণ ব্যর্থ হ্চছে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে। অথচ ভারতসেবী মীর জাফরদের মুসলিম স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তকে তুলে ধরার জন্য একাত্তরের ঘটনাবলি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একাত্তরের ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে রয়েছে তাদের কৃত অপরাধের রক্তাত্ব স্বাক্ষর।

ইতিহাসের মধ্যে থাকে অমূল্য জ্ঞানের ভান্ডার। অতীতের ইতিহাস থেকে যেমন পাওয়া যায় শয়তানী শক্তির পরিচয়, তেমনি পাওয়া যায় সঠিক পথে সামনে চলার প্রয়োজনীয় জ্ঞান। বিজ্ঞান না জানার কারণে কোন জাতি জাহান্নামী হয় না, জাহান্নামী হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণে। তখন জ্ঞানহীন কাপালিকগণ নিজ যুগের ফিরাউনকেও পদসেবা দেয়। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ন্যায় স্বৈরাচারি, বাকশালী ও মানব-হত্যাকারিদের নেতা হওয়ার পিছনে রয়েছে তো কাপালিক-সুলভ এ অজ্ঞতা। তাদের কারণেই তো দেশে প্লাবন এসেছে গুম, খুন, ধর্ষণ ও পিটিয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতির। মহান আল্লাহতায়ালা তাই তাঁর পবিত্র কোর’আনে জীববিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা বা গণিতের পাঠ দেননি, কিন্তু বিপুল পাঠ দিয়েছেন ইতিহাস জ্ঞানের। পরিতাপের বিষয় হলো সত্য জ্ঞান তুলে ধরায় মহান আল্লাহতয়ালার সে পবিত্র সূন্নত বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের দ্বারা পালিত হয়নি। অথচ এটিই কাঙ্খিত ছিল যে, একাত্তর নিয়ে সবচেয়ে বেশী লেখা-লেখি ও গবেষণা হবে ইসলামপন্থিদের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেটি হয়নি। তারা সে ইতিহাসকে বরং ঢাকার চেষ্টা করেছে। ইতিহাস চর্চার এ অঙ্গনে তাদের অনুপস্থিতি শত্রুপক্ষের জন্য যেটি সহজ করেছে তা হলো ইতিহাস বিকৃতি। একাত্তরকে ভূলে নয়, বরং ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ পর্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং শিক্ষা দান করেই ইসলামের পক্ষের শক্তিকে সামনে এগুতে হবে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post কিছু অপ্রিয় ভাবনা-১
Next post উত্তর আমেরিকা বাংলা কবিতা ও সাহিত্য সম্মেলন ২০২০ : থাকছে বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদযাপন
Close