Read Time:9 Minute, 6 Second

কাজী মোশাররফ হোসেন
‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এই আমার দেশ এই আমার প্রেম।’
(কথা: আবু জাফর)
দক্ষিণ বঙ্গের (বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল) একুশটি জেলার রাখালেরা যুক্ত হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজধানীসহ অপর তেতাল্লিশটি জেলার রাখালদের সঙ্গে মৈত্রী গড়তে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন ২০২২। মেঘনা, যমুনা, সুরমা, রূপসা, তিতাস সেতু বহু আগেই মিতালী করেছে দুপারের রাখালদের সঙ্গে, একই ঘরের মধ্যে দূরের লোক ছিল দক্ষিণ বাংলাবাসী, সারা বাংলাদেশের সকল মানুষকে একই সুতোয় বাঁধতে যাচ্ছে আমাদের সকলের প্রাণের সেতু, স্বপ্নের সেতু, বহু আকাঙ্খিত-পদ্মা সেতু। নদী পাড়ে চরে বেড়ায় রাখাল গরুর পাল নিয়ে, মাঝি নৌকা বায়, জেলে মাছ ধরে, নদী মেখলা এই দেশটিকে নদী জালিকা করেছে অন্বয়, সেতু তাকে আরও শক্ত করে বাঁধল মায়ার ডোরে এদেশের সকল মানুষকে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজ বাস্তবায়িত হলো তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা জননেত্রী, স্বর্ণ মানবী বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
না, এই সেতু নির্মাণ যাত্রা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দেশি ও বিদেশি শত্রæরা ছিল এর পিছনে ষড়যন্ত্রকারী। তারা আমাদের সহজ শর্তে বিশ^ ব্যাংকের ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে দেয়। বিশ^ব্যাংক প্রতিনিধি মিস গোল্ডস্টেইনের কান ভারি করে এরা, বেঁকে যায় বিশ^ ব্যাংক। কানাডাতে মামলা রুজু হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছতার স্বার্থে বরখাস্ত করেন নির্দোষ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে, পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন সেতুমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। কানাডা কোর্ট বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নির্দোষ ঘোষণা করে এবং মামলা খারিজ করে দেয়। এর ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছয় বছর পিছিয়ে যায় এবং ১.২ বিলিয়ন ডলার সহজ শর্তের ঋণ থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। সময় যত যায়, নির্মাণ খরচ ততই বাড়ে এবং এটিই নিয়ম অর্থাৎ বারো হাজার কোটি ডলার সহজ শর্তের ঋণ বঞ্চিত হয়ে তা চীন থেকে গ্রহণে বাধ্য হয়।
শেখ হাসিনা দমে যাননি। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ছিল পাহাড় সমান। কিন্তু স্বর্ণমানবী শেখ হাসিনা তাঁর পর্বত তুল্য প্রজ্ঞা দিয়ে সে বাধা অতিক্রম করেন। ৭০:৩০ খরচ শেয়ারে অর্থাৎ বাংলাদেশ ৩০ ভাগ নির্মাণ খরচের যোগানে প্রতিশ্রতি দিয়ে চীনের সঙ্গে এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শুরু করে। করোনাকালীন সময়েও চীন এ কর্মযজ্ঞ থেকে দূরে সরে যায়নি। কিন্তু দেরি হওয়ার কারণে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় তিরিশ হাজার কোটি টাকায়। কয়েকটি কোম্পানি দরপত্র ক্রয় করলেও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লি: দরপত্র জমা করে। একক দরপত্র দাতা হওয়ায় তারা নিজেরাই তাদের দরপত্রের ১২% কম দামে সেতুটি নির্মাণে রাজি হয় ও কাজ শুরু করে।
এই বহুমুখী পদ্মা সেতু নির্মাণে বহু বিশ^খ্যাত দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত হয়েছে। তার মধ্যে অঊঈঙগ, ঝগঊঈ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ, ঘড়ৎঃযবিংঃ ঐুফৎড়ষরপ ঈড়হংঁষঃধহঃং, অঈঊ ঈড়হংঁষঃধহঃং, অধং ঔধশড়নংবহ ধহফ ঐজ ডধষষরহমভড়ৎফ, কড়ৎবধ ঊীঢ়ৎবংংধিু পড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ উল্লেখযোগ্য।
এপ্রোচ রোডের কাজে বাংলাদেশের কোম্পানি অনফঁষ গড়হবস ষঃফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বুয়েট অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁর নেতৃত্বে একদল প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ সশ^স্ত্র বাহিনীর বিশিষ্ট ইউনিটগুলো এই সেতু নির্মাণে কাজ করে চলেছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে আর্থিকভাবে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের আপামর জনগণ, বাংলাদেশিদের বৈদেশিক মুদ্রা, চীনা সরকারের আর্থিক সাহায্য, জাপানের অউই, ঔওঈঅ, ঔউই ইত্যাদি সংগঠন।
মূল সেতুতে যা আছেÑ প্রথম স্তরে বা নিচের স্তরে রেলগাড়ির যাতায়াত ব্যবস্থা। দ্বিতীয় স্তরে বা উপরের স্তরে থাকবে দুই লেন করে আসা-যাওয়ার চার লেন সড়ক। সর্বোচ্চ গভীরতার খুঁটির দৈর্ঘ্য ১২২ মিটার। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্ত ২২. ৫ মিটার। খুঁটির সংখ্যা ৪২টি।
প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ৩৭-৩৮ খুঁটির মাঝে ২০১৭ সালের অক্টোবরে। এবং শেষ স্প্যান বসানো হয় ৪১ তম খুঁটিতে ১০ ডিসেম্বর ২০২০। শেষের রাস্তার ¯øাবটি বসানো হয়েছিল ২৪ শে আগস্ট ২০২১। দেড় বছরের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করে শুভ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন ২০২২।
হাজার হাজার বাংলাদেশি মানুষ এই সেতুর সামান্য শ্রমিকের কাজ পেয়েও বিশ^জয়ের হাসি দেখেছি তাদের চোখে মুখে। তারা নির্মাণ করলেন, দেশকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ শ্রম। চৌদ্দ হাজার গৃহস্ত পরিবারকে হতে হয়েছে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ছাড়া। তাদের মুখে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বেদনার ছাপ দেখিনি। দেখেছি জাতিকে সর্বস্ব দান করেও আনন্দিত হতে। এই তো বাঙালি, বাংলাদেশি-দিতে জানে প্রয়োজনে সব উজাড় করে তার দেশের জন্য জনগণের জন্য।
পদ্মা সেতু সদৃঢ় সংযোগ সাধন করল দেশের ৬৪ জেলাকে। উত্তপ প্রান্তে মাওয়া ঘাট-মুন্সিগঞ্জ, দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরিয়তপুর। মাওয়া ঘাট থেকে স্বাগত জানাবে দক্ষিণবঙ্গবাসীকে, অপরদিকে ঢাকাবাসীসহ অপর জেলার সবাইকে স্বাগত জানাবে জাজিরা, শরিয়তপুর। রেলপথ ও সড়ক পথের মাধ্যমে মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর যুক্ত হলো বাংলাদেশের সকল প্রান্তে। অনুমান করা হচ্ছে যে এই সেতুর মাধ্যমে দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে ১.২৬ ভাগ।
এই বহুমুখী সেতুর গুরুত্ব আছে আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও।
মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে মালামাল সহজেও যেতে পারবে ভুটান, নেপাল, পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, আগ্রা থেকে দিল্লী পর্যন্ত প্রসারিত হবে এর সুফল।
অদম্য সাহসী স্বর্ণমানবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য কঠোর আত্মদৃঢ়তায় বহু বাধার মুখেও পদ্মা বহুমুখী সেতু খুঁজে পেল সফলতার মুখ। এই সফলতা, এই চাওয়া বাংলাদেশের সকল মানুষের। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে আর এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পদচিহ্ন আমাদের এই স্বপ্নের সেতু, প্রাণের সেতু, পদ্মা সেতু, জয় পদ্মা সেতু, জয় বাংলা, জয় বাংলাদেশ।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যুক্তরাজ্যে ‘নোয়াখালী উৎসব’
Next post এখনো নিবিড় পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া
Close