ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সঙ্গীত বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহসীনা আক্তার খানম ওরফে লীনা তাপসী খানের বিরুদ্ধে পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সঙ্গীতশিল্পী ইফফাত আরা নার্গিস। নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক সঙ্গীতশিল্পী ইফফাত আরা নার্গিস ঢাবির এই শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি ও নজরুল পদক বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন।
রবিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান ইফফাত আরা নার্গিস।
সংবাদ সম্মেলনে লীনা তাপসীর লেখা ‘নজরুল-সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’ বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় অন্য লেখকদের বইয়ের কোথাও হুবহু, কোথাও আংশিক লেখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নার্গিস।
ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, ‘সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে আমি লীনা তাপসী খানের নজরুল-সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার গ্রন্থটি সংগ্রহ করি। কিন্তু বইটি পাঠ করে আমার এর আগে পাঠ করা তিন-চারটি গ্রন্থের সঙ্গে বেশ কিছু অংশের হুবহু মিল খুঁজে পাই, যা পরিষ্কার চৌর্যবৃত্তি। চুরির ওপর ভিত্তি করে যদি তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচিত হয়ে থাকে তবে, এ ডিগ্রি তদন্তপূর্বক বাতিল হলে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন সঙ্গীতশিল্পী হয়ে সঙ্গীত গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি আমাকে খুবই আহত করেছে। সঙ্গীত বিষয়ে একজন শিক্ষকের রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক অপকর্ম আজ আমাকে বিষয়টি তুলে ধরতে বাধ্য করেছে। আমি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার চৌর্যবৃত্তি নিয়ে অভিযোগ তুলছি। সেই শিক্ষকের নাম মহসিনা আক্তার খানম। যিনি কিনা তাপসী খান ছদ্মনামে সঙ্গীতজগতে পরিচিত। তার মতো একজন পরিচিত শিল্পী ও শিক্ষক যখন চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেন, তখন আমাদের কষ্ট হয়। অভিযোগটি তদন্তপূর্বক শাস্তি প্রদানের দাবিতে আমার এই বিবেকতাড়িত প্রতিবাদ।’
ইফফাত আরা নার্গিস আরও বলেন, ‘এই বইটি পিএইচডির সঙ্গে সম্পর্কিত না হয় তবে গবেষক হয়ে অন্যের গ্রন্থ থেকে যথাযথ তথ্য সংকেত উল্লেখ না করে নিজের গ্রন্থে ব্যবহার করে সে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন। তার যথাযোগ্য বিচার হওয়া উচিত। এই অভিসন্দর্ভের কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন, এই গ্রন্থের কারণে তিনি পদোন্নতি নিয়েছেন, এই গ্রন্থের জন্য তিনি নজরুল পদকও লাভ করেছেন। অর্থাৎ এই চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে তিনি আর্থিক সুবিধা, পেশাগত সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা গ্রহণ করেছেন, যা দুর্নীতি হিসেবেও গণ্য।
এসময় তিনি লীনা তাপসীর সেই বইয়ের যেসব জায়গায় লেখা কপি করার অভিযোগ করেছেন তার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
এই ঘটনায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, ২৮০ পৃষ্ঠার গ্রন্থে ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপি স্ক্যান করে ঢোকানো হয়েছে মূল পাঠ হিসেবে, যা অনৈতিক। এই স্বরলিপির স্থান হতে পারতো গ্রন্থের পরিশিষ্টে। মূল পাঠে এই স্বরলিপি কোনোক্রমেই স্থান পাওয়ার কথা নয়। এটিও একধরনের চৌর্যবৃত্তি। দেখা যাচ্ছে যে ২৭৭ পৃষ্ঠার বইয়ের মধ্যে ৮০ (স্বরলিপি)। ২৬ (শ্যামপ্রসাদ) + ৪৬ (কাকলী) +১৭ (পরিশিষ্ট) = ১৬৯ পৃষ্ঠা লীনা তাপসী খানের রচনা নয়। এগুলো অন্যের গ্রন্থ থেকে হুবহু গৃহীত। বাকি ১০১ পৃষ্ঠা লীনা তাপসীর খানের লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। তার মধ্যে ইদরিস আলীর গ্রন্থ থেকেও নেওয়া হয়েছে। যথাযথ অনুসন্ধান হলে প্রমাণিত হতে পারে যে ওইসব পৃষ্ঠায় ব্যবহৃত তথ্যও লেখকের নয়। এমতাবস্থায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, আমার অভিযোগটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। কেবল উপাচার্য নন, দুজন উপ-উপাচার্য এবং সিন্ডিকেটের সকল সদস্যের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু তদন্তের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, বরং লীনা একজন জাতীয় অধ্যাপকের দোহাই দিয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে কেউ তার কিছুই করতে পারবে না। এই সংবাদ যাতে প্রচারিত না হয় সেই ব্যাপারে তিনি তদবির করে বেড়াচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কেন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরেও তদন্ত করছে না, সেই রহস্য বুঝতে পারছি না।
সংবাদ সম্মেলন থেকে পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন নায়েমের সাবেক এই পরিচালক।
দাবিগুলো হলো- অভিযোগ তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক লীনা তাপসীর পিএইচডি ডিগ্রি বাতিল করা; এ ডিগ্রির জন্য প্রাপ্ত সব সুবিধা প্রত্যাহার করা; এ ডিগ্রি প্রদানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে শাস্তি প্রদান করা; এ ডিগ্রির ওপর রচিত গ্রন্থ- নজরুল সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার বাতিলের জন্য কবি নজরুল ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া; এ গ্রন্থের জন্য প্রাপ্ত নজরুল পদক বাতিল করে নজরুল পদককে কলঙ্কমুক্ত করা।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক লীনা তাপসী খান একে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে নিজে জালিয়াতি করে কোনো সার্টিফিকেট বের করিনি, আমার একটা বোর্ড ছিল, সুপারভাইজার ছিল। আমার পিএইচডির সুপারভাইজার ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, আজ তাকেও প্রশ্ন করা হচ্ছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা র্যাংকিংয়ে নিতে চাচ্ছি, আমরা চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা জায়গায় পৌঁছাক। অথচ যার কোনো পিএইচডি ডিগ্রি নেই, যার কোনো লেখা নেই তিনি এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আঙুল তুলছেন। তিনি অন্যের প্ররোচণায় আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছেন, অথচ এর কোনো ভিত্তি নেই।
অন্যদিকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে না জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ তোলার সমালোচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। উপাচার্য বলেন, ‘উনি (ইফফাত আরা নার্গিস) দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। উনি আন্তরিক হলে সহায়তা করলে, নিয়মনীতি অনুসরণ করে অভিযোগ করলে, তখন আমরা দেখতে পারতাম যে বিষয়টা আসলে কী। অনেক সময় তো বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে। অভিযোগ এলেই তো তদন্ত করা যায় না। এখানে মানুষের সম্মান-মর্যাদার বিষয় জড়িত থাকে। আর এসব বিষয়ে আমরা খুব কঠোর। অপরাধী যেই হোক না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
More Stories
শাহজাহান ওমরের হুংকার, ‘আমি আবারও এমপি-মন্ত্রী হব’
গ্রেপ্তারের পর ঝালকাঠি-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর হুংকার দিয়ে বলেছেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এসব মামলা আমার...
মুহাম্মদ ইউনূসকে যেতে দেবেন না, ধরে রাখুন : শফিক রেহমান
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমান। তিনি বলেন, “তাকে...
বিচারের পর আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে : ড. ইউনূস
ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে সেগুলোর বিচার শেষে দলটিকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে বলে...
সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া
ছয় বছর পর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেল হাস্যাজ্জ্বল খালেদা জিয়াকে। সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশের আসনে...
শেখ হাসিনাকে ফেরানোর নির্দেশনা নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তৌফিক হাসান বলেছেন, ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে দুই দেশের বৈঠকে আলোচনার সুযোগ...
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে কথা বললেন উপদেষ্টা মাহফুজ-আসিফ-নাহিদ
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ...