ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে নির্বাচনের আগে বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে বিজেপি। বুধবার (২ অক্টোবর) স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ঝাড়খণ্ডে এক জনসভায় বলেছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে ওই রাজ্যে। এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো বিজেপি নেতারা একাধিকবার মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের জন্যই ঝাড়খণ্ডের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। আদিবাসী-মূলবাসীরা অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন, এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন বিজেপি নেতারা।
বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ অভিহিত করা বা ‘খুঁজে বের করে করে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ’ করার হুমকিও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা। বেশিরভাগ সময়েই বাংলাদেশ সরকার ওইসব মন্তব্যের পরেও জোরালো প্রতিবাদ জানায়নি। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের এক জনসভায় অমিত শাহর মন্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ঢাকায় ভারতের উপ-রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে প্রতিবাদ নোট দিয়েছে বাংলাদেশ।
এভাবে প্রতিবাদ জানানো অতি বিরল ঘটনা বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের জন্য ঝাড়খণ্ডের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে– এই মন্তব্য করার পরে বাংলাদেশ সরকার কী প্রতিক্রিয়া দেয় বা আদৌ কিছু বলে কি না, তা এখনও জানা যায়নি। তবে মোদীসহ বিজেপি নেতাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বারবার মন্তব্য করা নিয়ে সরব হয়েছে ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতাসীন জোট।
তারা প্রশ্ন তুলছে, ঝাড়খণ্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ২৪ বছরের মধ্যে ১৬ বছরই ক্ষমতায় ছিল বিজেপি সরকার। যদি সত্যিই অনুপ্রবেশ হয়ে থাকে, তারা এতদিন কেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ইস্যুটা সামনে আনেনি? কেন ভোটের আগে বিষয়টা তোলা হচ্ছে বিজেপির তরফে? বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রাজ্যগুলিতে নির্বাচনের সময়ে অনুপ্রবেশের ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলে আসলে তারা হিন্দুভোট মেরুকরণের চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা ব্যক্তিদের জন্য দুটি পৃথক শব্দ ব্যবহার করে বিজেপি। সেদেশ থেকে আসা ব্যক্তি বা পরিবার যদি হিন্দু হয়, তাহলে তাকে শরণার্থী বলা হয়। আর সেই ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় যদি হয় মুসলমান, তাহলে তাকে অনুপ্রবেশকারী বলা হয়। তাই বারবার বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটা বলে আসলে বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে আসা মুসলমানদেরই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেন বিজেপি নেতা-নেত্রীরা।
ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনের আগে বিজেপি ‘পরিবর্তন যাত্রা’ নাম দিয়ে র্যালি করেছে। সেটার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে হাজারিবাগে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদীর ওই ভাষণ পুরোটাই রয়েছে তার আনুষ্ঠানিক এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে।
রাজ্যের ক্ষমতাসীন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের জোট সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা সরকার চালাচ্ছে, ঝাড়খণ্ডের পরিচয়ই বদলে দিতে চায়, তারা ঝাড়খণ্ডের শতাব্দী প্রাচীন নিজস্বতা ধ্বংস করে দিতে চায়। এদের কর্তৃত্ব যাদের হাতে সেই কংগ্রেস চায় ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে। ওরা জানে, চিরকাল তারাই আদিবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করে এসেছে। কোনও দিন তাদের সামনের সারিতে আসতে দেয়নি। তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা নতুন ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চাইছে।
সাঁওতাল পরগণার উদাহরণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে আদিবাসী জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে, অন্যদিকে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা সমানে বেড়ে চলেছে।জনবিন্যাসে বিপুল পরিবর্তন হচ্ছে। আদিবাসী আর হিন্দুদের সংখ্যা কমেছ। আপনাদের কাছে জানতে চাই ঝাড়খণ্ডে এই পরিবর্তন আপনাদের চোখে পড়ছে কি পড়ছে না? বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বাড়ছে কি বাড়ছে না?
জনসভায় উপস্থিত মানুষের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর আরও প্রশ্ন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা এখানে জমি দখল করছে কি না? ঝাড়খণ্ডের নারীদের, আদিবাসী নারীদের তারা নিশানা করছে কি না? আপনারা এই বিপদ দেখতে পাচ্ছেন, জনবিন্যাসে এই বদল দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ঝাড়খণ্ড সরকারের চোখে পড়ছে না। ক্ষমতাসীন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-কংগ্রেস জোট বলছে বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ এনে আদিবাসীদের মধ্যে মেরুকরণের চেষ্টা করছে বিজেপি। তাদের কথায়, ২৪ বছর হয়েছে ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার মধ্যে ১৬ বছরই ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। তখন কেন বিজেপি জনবিন্যাসের বদলের প্রসঙ্গ তোলেনি?
ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অধিকার রক্ষায় সরব অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিক দয়ামণি বার্লা সম্প্রতি কংগ্রেস দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, জনবিন্যাসে বদল ঘটছে, সেটা কি বিজেপির এখন মনে হলো? এই রাজ্যের জন্ম হয়েছে ২৪ বছর হলো, তার মধ্যে বিজেপিই তো ১৬ বছর রাজত্ব করেছে। যদি সত্যিই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা এখানে এসে থাকেন, সেটা তাদের সরকার আটকাতে পারেনি কেন?
বার্লা বলেন, আবার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বও তো কেন্দ্রীয় সরকারের। তাদের বিএসএফ কী করছে? এইসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মেরুকরণ করার চেষ্টায় বারবার অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ তুলছে বিজেপি।
তার কথায়, এটা ঠিকই আদিবাসী সমাজের বহু মানুষ জমি-জঙ্গল হারাচ্ছেন। কিন্তু কাদের কাছে? কারা আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত করছে? কেন্দ্রীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরাই তো জোর করে আদিবাসী জমি দখল করছে। কয়লা খনি অঞ্চলে আদিবাসী সংখ্যা কমেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের জমি তো হয় উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নামে অথবা বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর কারখানা ইত্যাদি বানানোর জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে। সেই দায় কার?
দয়ামণি বার্লা আরও বলছিলেন, জমি-জঙ্গল হারিয়ে বহু আদিবাসীই এখন পরিযায়ী হয়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন। সেই পরিসংখ্যান থেকে এরকম একটা ভুল ব্যাখ্যা খাড়া করা হচ্ছে যে আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন ভবিষ্যতে। যে ব্যাখ্যা, বার্লার মতে রাজনীতির জন্য করছে বিজেপি।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, ঝাড়খণ্ডে বহু বাংলাভাষী মুসলমান বাসিন্দা রয়েছেন। তারা সেখানকারই আদি বাসিন্দা। বাংলায় কেউ কথা বলছে দেখলেই তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে মনে করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। সেটা অনুচিত।
More Stories
বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক থাকবে ভারতের, আশা জয়শঙ্করের
বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় নতুন সরকার এলেও প্রতিবেশী দেশ দুটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ই থাকবে বলে মনে করেন দেশটির...
ভারতের বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা কালিম সিদ্দীকীর যাবজ্জীবন কারদণ্ড
ভারতের বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা কালিম সিদ্দীকীকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছে স্থানীয় একটি আদালত। বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দেশটির জাতীয় তদন্ত সংস্থা...
পদত্যাগে রাজি মমতা
চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য নবান্নের সভাঘরে বৃহস্পতিবার দু’ঘণ্টার বেশি সময় বসে ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বৈঠক হয়নি।...
শেখ হাসিনার পতনে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে ভারত: শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানের নিবন্ধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এই মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমসহ সব...
সেভেন সিস্টার্সের ৬০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে চীন
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সাত রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে...
যতদিন পর ভারতে অবৈধ হয়ে যাবেন শেখ হাসিনা
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন ভারতে আশ্রয় নেন তিনি।...