Read Time:10 Minute, 27 Second

কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে এক সময় বিজেপির হাত ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চরম বিরোধী হিসেবেই পরিচিত করেছেন নিজেকে। ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্যে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু যখন নেই, তখন মমতাকে নিজেদের কণ্ঠস্বর ভাবছেন আঞ্চলিকসহ সর্বভারতীয় দলগুলোর নেতারাও। রোববার ফলাফল স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বার্তা পাঠিয়েছেন তৃণমূল নেত্রীকে। তাদের উচ্ছ্বাস. অভিনন্দন এবং বিবৃতি থেকে স্পষ্ট, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের লড়াইটা মূলত আজ থেকেই শুরু হয়ে গেল তৃণমূল নেত্রীকে সামনে রেখে।

সমাজবাদী পার্টি থেকে শিবসেনা, আপ থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্স— সমস্ত শীর্ষ বিরোধী নেতারাই মোদী-অমিত শাহের সঙ্গে মমতার এই লড়াকু ভূমিকার অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন তাদের টুইট ও বিবৃতিতে। এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার টুইট করে বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন তার এই দুর্দান্ত জয়ের জন্য। আসুন, মানুষের কল্যাণের জন্য আমরা একত্রে কাজ করতে থাকি এবং সবাই মিলে এই অতিমারির মোকাবিলা করি।”

আগামী বছরেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গের পরে এই বিধানসভা ভোটটিও চব্বিশের লোকসভা ভোটের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা এসপি নেতা অখিলেশ সিংহ যাদবের বার্তা, “বাংলার সচেতন মানুষ, লড়়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের অক্লান্ত পরিশ্রম করা নেতা ও কর্মীদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। তারা বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিকে বাংলায় হারিয়েছেন। বিজেপি যে ভাবে অপমানজনক ঠাট্টার সুরে ‘দিদি ও দিদি’ বলে গিয়েছে, আজকের ফল তার মুখের মতো জবাব।”

‘হ্যাশট্যাগ দিদি জিও দিদি’ তিনি জুড়েছেন তার এই টুইটের সঙ্গে। তারই সহনেতা কিরণময় নন্দ তো খোলাখুলিই জানালেন, ২০২৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়়তে প্রস্তুত তার দল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ এই জয়ের দিনই দেশবাসীকে বিনামূল্যে কোভিড প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার, সীতারাম ইয়েচুরি, উদ্ধব ঠাকরে, সোনিয়া গান্ধীসহ মোট তেরো জন বিরোধী নেতার একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়। উল্লেখ্য, এই দাবি সর্বপ্রথম তুলেছিলেন তৃণমূল নেত্রীই। আজও সাংবাদিক সম্মেলনে সেই দাবি জানিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, যদিও সনিয়া গাঁধীও রয়েছেন, কিন্তু বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিরোধী জোটে অগ্রণী ভূমিকা নিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দেখা যাবে।

বিরোধী শিবিরের অধিকাংশ নেতার মতে, বাংলার এই রায় বিজেপির ‘এক রাষ্ট্র এক দল’ অথবা হিন্দুরাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত প্রচারের বিরুদ্ধে একটি জেহাদ। তৃণমূল নেতা সুখেন্দুশেখর রায়ের কথায়, “এ দিনের এই ফলাফল আঞ্চলিক আশার জয়। বিজেপির দিল্লি-কেন্দ্রিকতা এবং গোটা দেশকে দিল্লির বশংবদ করে তোলার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ভোট দিয়েছেন। গোটা দেশের ক্ষমতাকে দিল্লির করিডরে কুক্ষিগত করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।” রাজনৈতিক সূত্রের মতে, শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গই নয়, কেরল বা তামিলনাড়ুর ভোটেও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে, আঞ্চলিক শক্তির বিকাশের পক্ষেই ফলাফল দেখা গিয়েছে।

মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন- “বিজেপিকে সহজেই হারিয়ে দেওয়ার জন্য মমতাজী ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অভিনন্দন।”

কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা মমতা এবং বাংলার মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “বিজেপি-র টাকা এবং পেশীশক্তি এবং বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়়াইটা ছিল। রাজ্যের মানুষ ঘৃণা এবং বিভেদের বদলে শান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্বকেই বেছে নিয়েছেন।”

শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের কথায়, ‘‘বাংলার বাঘিনি একাই লড়়ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাকে হারাতে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। সব শক্তিকে হারিয়ে তিনি জয়ী হয়েছেন।’’ তৃণমূল নেত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ ও বিএসপি নেত্রী মায়াবতীও।

তৃণমূল নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছে কাশ্মীর। পিডিপি প্রেসিডেন্ট মেহবুবা মুফতির টুইট, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের কর্তাদের অভিনন্দন এই জয়ের জন্য। বিভেদকামী এবং ধ্বংসকামী শক্তিকে হারানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কুর্ণিশ।” এনসি-র প্রবীণ নেতা ওমর আবদুল্লা বলেছেন, “মমতাদিদিকে অভিনন্দন। বিজেপি এবং পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন, রান্নাঘরের বেসিন-সহ প্রায় সব কিছুই আপনার দিকে ছুড়েছিল! আপনি রয়ে গিয়েছেন। আগামী ৫ বছরের জন্য শুভ কামনা রইল।”

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে জিতে মোদী ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে সরাসরি মোদীর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মমতা। বারবার বিরোধীদের একজোট হওয়ার ডাক দিচ্ছেন।

কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলোকে জোটবদ্ধ করতে সক্রিয় রয়েছেন মমতা। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে মোদীবিরোধী প্রচারে নিজের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হয়েও সরব হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে অখিলেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাশ্মিরে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাদের আটক করার প্রতিবাদও জানাচ্ছেন।

এক্ষেত্রে লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় না থেকেও গোটা ভারতে মোদীবিরোধী শীর্ষনেতা হিসেবে মমতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর অন্য নেতারাও দৃশ্যত এখন ভরসা রাখছেন তার ওপরই। তাই মমতাকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তীব্র কটাক্ষ করেছেন মোদীকেও। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে বাকি বিরোধী দলগুলোও রুখে দাঁড়াবে।

টানা দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর মোদী-অমিত শাহ জুটি সর্বভারতীয় দলগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলার পর আঞ্চলিক দলগুলোকেও অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিচ্ছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার এই জয় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্য সবাইকে প্রেরণা জোগাবে বলে মনে করছে আনন্দবাজার পত্রিকা। কারণ তাদের ভাষায়, ‘মোদী-শাহের অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগাম টানলেন’ তো মমতাই।

হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, এখন সবার নজর ২০২৪ সালের নির্বাচনের দিকে। কংগ্রেস দুর্বল হওয়ার কারণে মমতার দল তৃণমূল নিজেদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। মমতাও দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ওমর আব্দুল্লাহ ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ভব থ্যাকারের সঙ্গেও আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখছেন। আগামী তিন বছর সুযোগ পেলে বিজেপি বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্বধায়ী ও আশ্রয়স্থলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চাইতে পারেন এই নেত্রী।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যেসব কারণে বিশাল জয় পেয়েছে তৃণমূল
Next post শিক্ষার্থীদের ভিসা দিচ্ছে সুইডেন
Close