নতুন প্রজন্মের অভিবাসী হিসেবে বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণী কিয়া আব্দুল্লাহ। এদিকে মা কথা বলেন সিলেটি ভাষায়, ফলে কমন কিছু শব্দের মধ্যে আটকা পড়েছিল তাদের মধ্যে কথাবার্তা।
এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে মা থেকে দূরে আটকে পড়েছিলেন কিয়া। লেখালেখির সূত্রে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি এবং মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে কাজ করেন। লেখালিখিতে বেশ নামও কুড়িয়েছেন।
লকডাউনে তার মা একাকিত্ব অনুভব করলে তখন কিয়ার মধ্যে উপলব্ধি হয় তার বাংলা শেখা উচিত। মূলত বাংলা তিনি জানতেনই, তবে ব্রিটিশ সমাজে খাপ খাওয়ানো ও আধুনিক শিক্ষায় বড় হতে গিয়ে সেই জানাটুকু তিনি হারিয়ে ফেলেন।
মায়ের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে কীভাবে তিনি আবার বাংলা রপ্ত করলেন সেই গল্পই লিখলেন গার্ডিয়ানে।
কিয়া বলেন, নিজের পরিবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর, আমি খুব কমই বাংলায় কথা বলতাম। ২০০৭ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর কেবল মায়ের সঙ্গেই আমি বাংলায় কথা বলি।
তিনি লেখেন, এক দশকের মধ্যে বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারাতে থাকি। মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় ধার করা শব্দের ওপর আমার নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। বাংলায় কিছু বলতে না পারলেই আমি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতাম। মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্য আমি তিনি বুঝবেন এমন শব্দই ব্যবহার করতাম, যেমন ‘ব্রেড’, বা ‘হসপিটাল’। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি এমন সব শব্দ ব্যবহার শুরু করলাম যেগুলোয় তিনিও বিভ্রান্ত হতেন, যেমন ‘পাবলিশ’, ‘পোস্টেজ’ বা ‘আরগুমেন্ট’।
এ ব্রিটিশ লেখিকা বলেন, কয়েক বছর শব্দের সঙ্গে অভিব্যক্তি ও অঙ্গভঙ্গি জোড়া দিয়ে চালিয়ে গেলাম আমরা। কিন্তু ২০২০ সাল এসব অভিব্যক্তিও আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। সেল্ফ-আইসোলেশনে গিয়ে ফোনে কথা বলার সময় আমরা শুধু শব্দই ব্যবহার করতে পারতাম, সংকেতের মাধ্যমে অভিব্যক্তি দেখাতে পারতাম না। আর শুধু শব্দে পরিপূর্ণতা প্রকাশে আমি তখন অক্ষম ছিলাম।
কিয়া বলেন, আমাদের কথাবার্তা ধীরে ধীরে অদ্ভুত ও কৃত্রিম হতে লাগল। বস্তাপচা জটলায় আটকা পড়ে আমি ঘুরেফিরে একই জানা প্রশ্নগুলো বারবার করতে থাকলাম- আজ কী করেছো? কী খেয়েছো? সারাদিন আর কী করবে? আমি তাকে কল করা কমিয়ে দিলাম। অবশেষে, গ্রীষ্মের একদিনে তিনি আমার বোনকে বললেন, তিনি একাকী হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পারলাম আমি ব্যর্থ হয়েছি- কেবল এই বছরই নয়, এর আগেও বহু বছর ধরে। আদতে, এই অনুধাবনের পরই আমি আমার ভাষা আবার শেখার প্রতিজ্ঞা করি।
এরপর কিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় বাংলায় পড়া ও শোনার জিনিস খুঁজে বের করা। কিন্তু টিভি ও রেডিওর বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই বাংলায় প্রমিত ভাষায় প্রচারিত হয়। আর এদিকে তিনি কথা বলেন চলিত সিলেটি ভাষায়। এর মধ্যে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের খোঁজ পান যেখানে স্প্যানিশ শেখানোর দেড় হাজারের বেশি শিক্ষকের বিপরীতে বাংলা শেখানোর জন্য ছিল মাত্র ২০ জন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে তাদের কেউ সিলেটি শেখাতো না।
এরপর রেডিও ও পডকাস্টেও তিনি সিলেটি শেখার কিছু পেলেন না। ‘৩০ দিনে সিলেটি বাংলা শিখুন’ নামে একটি ই-বুক কিনেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কারণ সেই বই থেকে আসলে শেখার মতো কিছু ছিল না।
একপর্যায়ে ইউটিউবে খুঁজে পান সিলেটি ভাষায় বুলেটিন। সপ্তাহে তিন দিন করে সেই নিউজ বুলেটিন দেখা শুরু করলেন কিয়া।
তিনি বলছেন, ভাষাটি আমি শিশু হিসেবে শিখেছিলাম, তাই নতুন করে আবার মৌলিক বিষয়গুলো শেখার প্রয়োজন ছিল না। আমার কেবল নিজের শব্দভান্ডার বৃদ্ধি করার প্রয়োজন ছিল। ইউটিউবে বুলেটিন শুনতে শুনতে আমার স্বতঃস্ফূর্ততা ফিরে আসতে শুরু করে।
কিয়া বলছেন, একপর্যায়ে আমি হারিয়ে যাওয়া শব্দ ফিরে পেলাম, নতুন অনেক শব্দও শিখলাম। অনেক দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীরাই কথা বলার স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলে। আমি নিজের স্বতঃস্ফূর্ততা ফিরে পাওয়ায় গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ছিলাম।
মায়ের সঙ্গে এখন কথা বলতে আটকায় না এ বাংলাদেশি ব্রিটিশ তরুণীর। তিনি বলেন, আমি আমার মাকে আরো ঘন ঘন ফোন দেয়া শুরু করেছি। আমি এখনো কিছু কিছু শব্দে আটকে যাই, কিন্তু আগের চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে নিজেকে ব্যক্ত করতে পারি। এখন আমি তিনি সারাদিন কী করেছেন, কী খেয়েছেন ও কী করবেন- এর চেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি। তিনি যখন নিজের কোনো পর্যবেক্ষণের কথা বলেন, আমি সেটি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারি।
কিয়া আব্দুল্লাহ বলেন, এই অদ্ভুত ও একাকী বছরে, ভাষা আমাকে কেবল আমার নিজের বিষয়ে জ্ঞানের চেয়ে আরো বেশিকিছু দিয়েছে। এটা আমাকে আমার মাকে বুঝতে শিখিয়েছে।
More Stories
দক্ষিণ আফ্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশি নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় গিয়াস উদ্দিন মিয়া (৪৬) নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এ সময় তার দুই ছেলে সিয়াম...
৫ বাংলাদেশিসহ ৪ শতাধিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করল যুক্তরাষ্ট্র
ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে মিছিল করার অপরাধে পাঁচ বাংলাদেশিসহ চার শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থীর ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র।...
লস এঞ্জেলেসে লিটিল বাংলাদেশ কমিউনিটির চাঁদরাত মেলা যেমন ছিল
শামসুল আরিফীন বাবলু রোজা শেষে ঈদ’কে স্বাগত জানাতে লস এঞ্জেলেসে লিটিল বাংলাদেশ কমিউনিটির উদ্যোগে চাঁদরাত উপলক্ষ্যে এক ঈদ মেলার আয়োজন...
সব রেকর্ড ভেঙে দেশের ইতিহাসে এক মাসে এতো রেমিট্যান্স এসেছে
সব রেকর্ড ভেঙে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক মাসে রেমিট্যান্স এসেছে। গত মার্চ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে তিন বিলিয়ন (৩০০ কোটি)...
মিয়ানমারে বাংলাদেশি নাগরিকরা নিরাপদ রয়েছেন : রাষ্ট্রদূত
মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকরা নিরাপদ রয়েছেন। শুক্রবার (২৮ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এ...
জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্যালিফোর্নিয়া’র ইফতার
শামসুল আরিফীন বাবলু, প্রবাস বাংলা ডেস্ক যুক্তরাস্ট্রে বসবাসরত বৃহত্তর সিলেটিদের সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব ক্যালিফোর্নিয়া’র আয়োজনে ইফতার ও দোয়া মাহফিল...