Read Time:7 Minute, 11 Second

 

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক দিন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও শিব সেনা পার্টির সমর্থকরা এদিন ধ্বংসাত্মক এক হামলা চালান উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদে। আর এ ঘটনা থেকেই পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ এক দাঙ্গা; ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়।

এই মসজিদ ভাঙতে প্রথম আঘাত করা ব্যক্তি হলেন শিবসেনার সাবেক সক্রিয় কর্মী বলবীর সিং। কিন্তু, ঘটনাক্রমে এখন তিনি পুরোদস্তুর মুসলিম। নাম বদলে হয়েছেন মোহাম্মদ আমির। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে আলখেল্লা। কথায় কথায় বলেন, আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহ। কাকডাকা ভোরে দেন আজান।

এক দিন যে বলবীর বাবরির চুড়া থেকে ইট খসিয়েছিলেন, আজ তিনিই ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়া মসজিদ মেরামতের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। ইসলামের পথে আসা মোহাম্মদ আমির পণ করেছেন, নতুন করে নির্মাণ ও সংস্কার করবেন ১০০টি মসজিদ।

বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজে অংশ নেওয়ার পর বলবীর সিংকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তার বাবা দৌলতরাম। এরপর আর ছেলের মুখ দেখেননি বাবা। মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন, বলবীরকে যেন তার (দৌলতরাম) মুখাগ্নি করতে না দেওয়া হয়।

বাবার এই আচরণে অবশ্য অবাক হননি বলবীর বা আজকের মোহাম্মদ আমির। তিনি জানান, তার পরিবার ছিল রাজপুত ঘরানার। তাদের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদ কখনোই ছিল না।

ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি তিন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছিলেন আমির। মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে থাকতেন পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে। বলবীরের বয়স যখন ১০ বছর, বাবা দৌলতরাম তখন সন্তানদের পড়াশোনার জন্য চলে যান পানিপথে।

মোহাম্মদ আমির জানান, তার বাবা বরাবরই গান্ধীর মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের যন্ত্রণা তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তাই, প্রতিবেশী সংখ্যালঘু মুসলমানদের আগলে রাখতেন। তার বাবা কোনো দিনই মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না। তারা কখনো মন্দিরে যেতেন না। বাড়িতে গীতা ছিল। কিন্তু, তিনি বা তার ভাইয়েরা কেউই সেটা কখনো পড়েননি।

পানিপথে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে হেয় করা হতো। পানিপথে বলবীর সিংয়ের পরিবারকেও হেয় করা হতো। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিলেন বলে পানিপথের স্থানীয় লোকজন তাদের অবজ্ঞা করতেন। একটা দুঃখবোধ তাড়িয়ে বেড়াতো তখনকার বলবীরকে।

আমির বলেন, পানিপথের কাউকে তেমন ভালো লাগতো না। এ রকম সময়েই দেখা হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি শাখার কর্মীদের সঙ্গে। তারা বলবীরকে বেশ সম্মান করতেন। দেখা হলে আপনি আপনি বলে সম্বোধন করতেন। তখন থেকেই বলবীর মিশতে শুরু করেন আরএসএসের কর্মীদের সঙ্গে।

শিবসেনা করতে করতেই বিয়ে করেন আমির। এমএ করেন রোহতকের মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময় প্রতিবেশীরা তাকে কট্টর হিন্দু ভাবতেন।

এখনকার মোহাম্মদ আমির বলেন, শিবসেনার লোকজনদের কাছ থেকে ‘সম্মান’ পেয়ে তাদের ভালো লেগে গিয়েছিল। শিবসেনাই তাকে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙতে। পাঠিয়েছিল বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালকেও। তারা হয়ে যান করসেবক (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে জড়িত স্বেচ্ছাসেবক কর্মী)।

বাবরি মসজিদ ভেঙে পানিপথে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে তাকে ও যোগেন্দ্রকে তুমুল সংবর্ধনা জানানো হয়। বাবরি মসজিদের মাথায় শাবল চালিয়ে ভাঙার পর দুটি ইট সঙ্গে এনেছিলেন তারা। সেগুলো শিবসেনার স্থানীয় কার্যালয়ে সাজিয়ে রাখা হয়।

সংবর্ধনার পর বাড়িতে ঢুকতেই বাবা বলবীরকে বলেন, হয় তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। অগত্যা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। স্ত্রীও তার সঙ্গী হলেন না। ওই সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন বলবীর। জানিয়েছেন, লম্বা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতেন তখন। বেশ কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গেছেন।

এরপর পুরোনো বন্ধু যোগেন্দ্র পালের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরও ভেঙে পড়েন বলবীর। জানতে পারেন, যোগেন্দ্র মুসলিম হয়ে গেছেন। যোগেন্দ্র নাকি তখন বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রর মনে হয়েছিল, পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র।

এরপরই আর দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে মাওলানা কলিম সিদ্দিকির কাছে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন বলবীর; হয়ে যান মোহাম্মদ আমির।

মোহাম্মদ আমির জানালেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত করতে অন্তত ১০০টি মসজিদ নতুন করে নির্মাণ ও মেরামত করতে চান তিনি। তার ভাষ্য, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু ভেঙে পড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলো মেরামতও করেছেন তিনি।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজন ও সহিংসতার রাজনীতি উসকে দিচ্ছে : এনসিপি
Next post দায়িত্ব নেওয়ার সময় নির্বাচন দেওয়ার কোনো শর্ত ছিল না : সাখাওয়াত হোসেন
Close