ভারতের নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের এমেরিটাস অধ্যাপক ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক উপদেষ্টা ব্রহ্মা চেলানি বলেছেন, ‘একই সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যে দ্বৈত আচরণ করছে, তা বোধগম্য নয়।’
‘একদিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে অঘোষিত সামরিক শাসন চললেও সে বিষয়ে একদম চুপ।’
জাপানের বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যম নিক্কি এশিয়ার ইংরেজি ভার্সনের মতামত পাতায় প্রকাশিত নিবন্ধে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন এমেরিটাস অধ্যাপক ব্রহ্মা চেলানি।
নিবন্ধে ব্রহ্মা চেলানি বলেন, ‘২০০৯ সালে (প্রধানমন্ত্রীর) দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুতগতির অর্থনৈতিক উন্নতির পথে নিয়ে গেছেন। যদিও বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির ফলে দেশটির অর্থ ব্যবস্থা বিরূপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু টানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের তুলনায় ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আহ্বানে আয়োজিত ২০২১ এবং এ বছরের শুরুতে ডেমোক্রেসি সম্মেলনের বাইরে রাখা হয়েছে বাংলাদেশকে। পাকিস্তানকে দুইবারই আমন্ত্রণ জানানো হলো, যদিও তারা এতে অংশ নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন একদিকে গণতন্ত্র সুসংহতকরণ উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশের যেসব কর্মকর্তা সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করবে তাদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলছে। অপরদিকে পাকিস্তানে অঘোষিত সামরিক আইন জারি হলেও সে বিষয়ে একদম চুপ থাকে মার্কিন প্রশাসন। অথচ পাকিস্তানে প্রতিনিয়ত গণগ্রেপ্তার, গুম ও নির্যাতন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
নিবন্ধে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অধিকার সুসংহতকরণের দীর্ঘ ইতিহাস বলে এটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ভূরাজনৈতিক অবস্থা-পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্র সুসংহত করার কথা বলে এমন বহু জায়গায় মার্কিন নীতি নির্ধারকরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’
অধ্যাপক ব্রহ্মা চেলানি বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন এই ভিসানীতির মধ্য দিয়ে মনে হয় দুটি জায়গা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চেয়েছে। একটি হলো দেশটির রাজনীতিবিদদের আত্মীয়স্বজন অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। আর তাছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানির বিরাট অংশ পশ্চিমা দেশগুলোতে যায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষস্থানীয় একটি গন্তব্য।’
প্রায় নয়টি গ্রন্থের লেখক ব্রহ্ম চেলানি বলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার মেয়ে হাসিনা অবশ্য গত এপ্রিলে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্র উৎখাত করতে চায় এবং এমন একটি সরকার বসাতে চায়, যাদের মাঝে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকবে না। এটি অগণতান্ত্রিক একটি কাজ হবে।’’
ব্রহ্মা চেলানির ভাষ্যমতে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমার, ইরান, বেলারুশ ও কিউবায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমহ্রাসমান প্রভাবে এসব নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা দিনে দিনে কমছে। যদিও এখন পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলোই বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থার কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ডলার এখনও বিশ্বের রিজার্ভের প্রাথমিক মুদ্রা হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে নিষেধাজ্ঞা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে আকর্ষণীয় পন্থা।
ব্রহ্মা চেলানি বলছেন, ‘ঢাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ কড়াকড়ির তেমন কোনো অর্থ মিলছে না। এশিয়ার নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তাতে শেখ হাসিনার সরকার বরং যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। অথচ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা করতে গত মাসে শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন বাইডেন প্রশাসনের একজনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না।’
সিঙ্গাপুরে এ মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের ভ্রু কুচকানি বা অঙ্গুলি হেলনের বিপরীতে কিছু করবে না। কিন্তু ঠিকই বাংলাদেশে এমনটি করা হচ্ছে, সে পথেই আগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।’
গবেষক ব্রহ্মা চেলানি বলেন, ‘বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র এখন যা করছে, তাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা চলাকালে তারা যে অবস্থান নিয়েছিল, সেই দুঃসহ স্মৃতি ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে। এখন আসলে কী চাইছে ওয়াশিংটন?’
More Stories
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সেজে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা, অবশেষে কারাগারে
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভুয়া পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করলেও অবশেষে কারাগারে ঠাঁই হলো অমরজিদ বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তির। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের...
সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া, অবস্থা স্থিতিশীল
‘লিভার সিরোসিস’সহ বেশকিছু শারীরিক জটিলতায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন...
আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা কেউ শোনে না, গ্যাবন-সুদানও না: কাদের
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা কেউ শোনে না। ভেনেজুয়েলা, গ্যাবন, সুদান...
মার্কিন ডলারের বিপরীতে আবারও কমলো বাংলাদেশের টাকার মান
মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আরও কমেছে টাকার মান। রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) রিজার্ভ থেকে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও আমদানি ব্যয় নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম...
ভিসা নীতির আওতায় পড়ছেন কারা স্পষ্ট করলেন পিটার হাস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তা স্পষ্ট করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক...
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি : মার্কিন ভিসা নীতিতে আমরা বিচলিত নই
বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারো অনুকম্পায় নয়। স্বাধীনতার সময় যারা বিরোধিতা করেছিল,...