Read Time:9 Minute, 45 Second

আমার লেখাটা যখন পোস্ট করবো তার ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমার বড় ভাই (মোহাম্মদ শামীম হোসেন) সমাহিত হবেন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লস এঞ্জেলসের একটি মুসলিম সমাধিস্হলে। একা এবং নিঃসংগ অবস্থায় আমাদের সকলের অগোচরে তিনি মারা গেছেন গত শুক্রবার (১৩ জানুয়ারী)। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)।

বাবার পেনশনের টাকার উপর ভর করে বিদেশে যেয়ে নিজের ভাগ্যের উন্মেষনে দেশ ছেড়েছিলেন তরুন বয়সে। প্রথমে সিংগাপুর তারপর দেশে এসে গার্মেন্টস ব্যবসা-শেষমেষ আমেরিকায় স্হিথু হওয়া। বাবার বড় ছেলে, অবসরপ্রাপ্ত পিতা একটা চাপ তো তার মধ্যে সব সময় ছিলো।
২০০৩ সালে তের বছরের অবৈধ নাগরিকের কলংক মোচন করে দেশে আসেন। ততদিনে বাবাও চলে গেছেন তাকে শেষ সময়ে না দেখার চাপা বেদনা বুকে নিয়ে। সবুজ কার্ডধারী হলেও তার মনের সবুজটা বোধহয় ততদিনে বিবর্ন হতে শুরু করেছে।
“বিয়ে আমি করবো না”- এমন একটা শক্ত ঘোষণা দিয়েই দেশে আসেন।
” শামীম কি আর দেশে আসবে না?” বাবা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে এমন প্রশ্ন তুলতেন। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ কে এতো দূরে পাড়ি দিতে হয়?
মা’ও তার মৃত্যুর আগে আমাদের কাউকে সামনে দেখলে তাকে শামীম মনে করতেন। আসলে এটা তার এক বিভ্রান্তি। আমার মা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। কান্না করেন না প্রকাশ্যে তবে ভীষণ পুড়েন ভিতরে। নয়টি জীবিত ছেলে মেয়ে! একটি না থাকলে কি হয়! এমন এক স্বার্থপর ভাবনায় তাকে শান্তনা দেওয়া হতো,
” আরে মা, আমরা আছি না”!
ডিমেনশিয়া আর অবসৃয়মান স্মৃতির কারনে আমাদের কাউকে কাউকে ভুল নামে ডাকতেন। কিন্তু বড় ছেলে যে তার পাশে নেই এটা তাকে লুকানো যেত না।
মায়েদের মনে হয় প্রতিটি ছেলে মেয়েকে আলাদা করে চেনার নিখুঁত ঘ্রান শক্তি থাকে! গা শুঁকে শুঁকে বলে দেয় ডিজিটাল আইডেন্টিটি। মায়ের ভীষণ চাপা সাহস ছিলো। ভেঙে পরতেন না। সেদিনের কথা মনে পড়ে কি!
কিডনাপ হয়ে গেল ভাই! ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের এক সকালে বাজার থেকে তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল জাসদের কিছু ছেলে। সাথে থাকা কাজের ছেলেকে ওরা বলে দিলো,
“যাও ওসি সাহেবকে বলো, সিদ্দিক মাষ্টার কে (সিদ্দিকুর রহমান, নব গঠিত জাসদের সেন্ট্রাল কমিটির নেতা)
না ছাড়লে ওকে (ভাই) ছাড়া হবে না”। অপহরণকারী দল নেতা পোখরাজ ( রাজ ট্রাভেলস বনানী) তখন দূর্ধষ ছাএ নেতা। বাজারের ৫ টাকা আর ব্যাগ কে পুকুরে ছুঁড়ে ফেললেন।
স্বাধীনতা উওর ঢাকার নবাবগঞ্জ এক ভয়ংকর সংঘাতপূর্ন জনপদ। প্রায় প্রতিরাতে এখানে লাশ পড়ে। থানার ওসির ছেলে অপহৃত!
এ এক অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। সারাদিন নিস্তব্ধ মা। কোন কথা নেই তার মুখে। মধ্যরাতের পর মার চাপা কন্ঠের কান্নার আওয়াজ পেলাম-
” ভাই ফিরে এসেছে! ”
২০০৩ সালে তার প্রত্যাবর্তন আরেক বার তেমনই এক স্বস্তির ছিলো। ফিরলেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের পাসপোর্টের মালিক হয়ে। ততদিনে গড়পরতা বাঙালীর সাংসারিক ভাবনার গন্ডী পার হয়ে এক বোহেমিয়ান জীবন বেছে নিয়েছেঃ
” সিঙ্গেল লাইফ”।
সাথে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী গোল্ডেন লাব্রাডর “সাথী”। তবে মধ্যবিও বাঙালী পরিবারের বড় ছেলের দায় তাকে চিন্তিত করতো। ভাই বোন সহ সবার আর্থিক দায় যেন তাঁরই দায়। বোনের বিয়ে ভাইয়ের ছেলের চিকিৎসা -ভাতিজার বিদেশে পড়ার খরচ -বোনকে বিদেশে সেটেল করা- দূরবর্তী আত্মীয় স্বজনের জন্য আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া- যেন বৃহওর পরিবারের সকলের আর্থিক চাহিদার এক এটিএম মেশিন। ২০০৮ সালে ক্যান্সার ধরা পড়লে ফুসফুসের একাংশ কেটে ফেলা হয়। খন্ডিত ফুসফুস নিয়েই এতো দিন বেঁচে ছিলো। নিজের একটি প্লটের মালিকানা ছোট ভাইয়ের নামে ছেড়ে, পৈত্রিক বাড়ির পূনঃর্নিমানে ফান্ডের ব্যবস্হা করে ক্রমে নিজেকে নিঃস্ব করে যাচ্ছিলেন। খুব জানতেন জাগতিক এসবই তার আর প্রয়োজন নেই। সেই যে ১৯৮০ সালে বাবার পেনশনের ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন তার ঋণ যেন তার শোধই হচ্ছিলো না।
তার মৃত্যুর পর তার লাশের দেশে প্রত্যাবর্তনের সকল ঝক্কি থেকে মুক্তি দিতে ফ্লোরিডায় থাকা ছোট বোনকে উইল করে লস এঞ্জেলসে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছের কথা লিখে যান। যে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য এতো বছর চেষ্টা করেছেন সে মাটি কি আর পর থাকে। দুনিয়ার সবটাই তো একজনের সৃষ্টি। যাকে সবচেয়ে আপন ভাবা হয় সে কি আসলেই আপন? যাকে পর ভাবি আমরা আসলেই কি সে পর? রক্তের সম্পর্ক না থাকলেই কি সে আপন হতে পারে না?
আজ তার দাফনের সব আয়োজনটি শেষ করছে তারই মতো আরেক ” সিঙ্গেল ” বন্ধু ল্যারী লেভিন। তারা ৩০ বছর একই বাড়িতে থেকেছে।
সব গুলো কেমোর ধাক্কা সে নিতে পারেনি। হাসপাতাল তাকে আর চিকিৎসা না দিয়ে বাসায় ‘পিসফুল ডেথ’ এর জন্য পাঠিয়ে দেয়। পেশাদার ফিলিপিনো কেয়ার গিভার আর ‘মুসলমানদের জন্য নাপাক “সাথীর” নজরদারীতে সে অপেক্ষা করতে থাকে শেষ দিন ও শেষ মুহুর্তের জন্য।
শেষ মুহুর্তটি কেমন ছিলো তার? ল্যারী লেভিন কে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“He died very peacefully”!. তার ছোট জবাব। He knew he is going to die,so stopped talking for last couple of days back.”
এই ল্যারীকেই ভাই রাতদিন পরিশ্রম করে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে। এখন ল্যারীর টার্ন তাকে শেষ মুহূর্তে বিদায় দেওয়া।
তুমি তো পাশের রুমে ছিলে তুমি কেমন করে জানলে ভোর বেলায় ওর শ্বাসকষ্টের কথা?
ভাইয়ের কুকুরটা বেশ কিছুদিন থেকে তার বিছানার পায়ের কাছে থাকতো। ভাই যত নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকলো ওরও খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যেতে থাকে। সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিতো। ১৩ জানুয়ারী ভোর বেলায় সে ঘন ঘন দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া শুরু করলে ‘সাথী’ বিছানা থেকে লাফিয়ে ছুটে যেয়ে পাশের রুমের ল্যারী আর কেয়ার গিভারকে জাগিয়ে দেয় এবং অস্হিরভাবে ছুটাছুটি করতে থাকে।
” Dogs can sense the death better “!- ল্যারী লেভিন তার বর্ননা শেষ করলো।
একজন ক্যাথলিক খৃষ্টান আর মুসলমানদের কাছে নাপাক সাদৃশ্য লাব্রাডর কুকুরের উপস্থিতিতে দুনিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্রের নাগরিক আমার ভাই আমাদের সকলের থেকে বিদায় নিলেন!!
ফ্লোরিডার বিমানবন্দরে আটকে পরা বোনটি পৌঁছাতে পারেনি ভাইয়ের কাছে। কফিনটি লস এঞ্জেলসের পাথুরে মাটির গহ্বরে ঢোকার সাথে সাথে একজন প্রবাসীর সংগ্রাম বহুল কষ্টকর জীবনের উপাখ্যানটি মুছে যাবে দুনিয়া থেকে।
কত কফিন ফেরত আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পতিত রেমিট্যান্স যোদ্ধার গালভরা নাম নিয়ে। আমার ভাই ফেরত আসেনি!

লেখক : প্রয়াত মোহাম্মদ শামীম হোসেনের ভাই নাসিম হোসেন

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতি ভার্জিনিয়ার সিনেটে
Next post নারীদের সম্পৃক্ত করে আমরা এগিয়ে যাব : প্রধানমন্ত্রী
Close