Read Time:11 Minute, 53 Second

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আইএমএফ তখনই ঋণ দেয়, যখন ওই দেশ ঋণ পরিশোধের যোগ্যতা অর্জন করে। আমরা সেই যোগ্যতা অর্জন করেছি বলেই আইএমএফ ঋণ দিচ্ছে। এখানে আমরা তেমন কোনো শর্ত দিয়ে ঋণ নিইনি।’

বুধবার সংসদের বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আইএমএফ’র ঋণের শর্তে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে এর ফলে মুল্যস্ফীতির চাপ সরকার কীভাবে সামলাবে সেই প্রশ্ন তোলেন।

জবাবে বিশ্বের কোনো দেশ বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি দেয় এমন প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছি, গ্যাসে ভর্তুকি দিচ্ছি। আমার প্রশ্ন হলো পৃথিবীর কোন দেশ গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়? কেউ দেয় না।’

এ সময় ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিকদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চাইলে যে মূল্যে কিনে আনব সেই মূল্য তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’

ভর্তুকির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়েছি। কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহারে সকলকে সাশ্রয়ী হতে হবে। ইংল্যান্ডে ১৫০ ভাগ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে এই ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধের পর। আমরা তো মাত্র ৫ শতাংশ আজকে বাড়ালাম, আর বাল্কে কিছু গ্যাসের দাম। এলএনজি আমরা যেটা ছয় ডলারে স্পট প্রাইসে কিনতাম, সেটা এখন ৬৮ ডলারে। কত ভর্তুকি দেবে সরকার? সরকার যে ভর্তুকিটা দেবে, সেটা তো জনগণেরই টাকা। আর দ্রব্যমূল্য আজেকে সারাবিশ্বেই বৃদ্ধি পেয়েছে।’

মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ‘আমরা নিম্ন আয়-মধ্যম আয়ের যারা তাদের জন্য টিসিবির ফেয়ার প্রাইস কার্ড দিয়ে দিয়েছি। যেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারে। তেল, চিনি, ডাল সীমিত আয়ের মানুষ ন্যয্য মূল্যে কিনতে পারে। সেই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি। এর থেকে যারা নিম্নআয়ের তাদের জন্য আমরা ১৫ টাকায় চাল আমরা দিচ্ছি। সেই সাথে তেল, ডাল ও চিনিও দেয়া হচ্ছে। আর একেবারে হতদরিদ্র যারা কিছুই করতে পারে না। তাদেরকে বিনাপয়সায় খাদ্য সরবরাহ করছি। স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে কষ্টে না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রেখে এই ব্যবস্থা করছি। কৃষিতে আমরা ব্যাপকভাবে ভর্তুকি দিচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইংল্যান্ডের মত জায়গায় ১৩ দশমিক তিন শতাংশ হচ্ছে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি। এটা একটা উন্নত দেশের কথা বললাম। পৃথিবীর সব দেশে এই অবস্থা বিরাজমান। বাংলাদেশ এখনো সেই অবস্থায় পড়েনি।’

ভর্তুকি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ; বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণে যদি ৪০, ৫০ ও ৬০ হাজার কোটি টাকা আমাকে ভর্তুকি দিতে হয় তাহলে সেটা কী করে দেব? এর ফলে দাম বাড়লে মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার যে চেষ্টা সেটা করে কিছুটা সফলতা দেখাতে পেরেছি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মুল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।’

সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের যদি বৃদ্ধি পায় পাশাপাশি মানুষ যদি একটু সাশ্রয়ী হয়।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবনে বিদ্যুতের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এভাবে যদি সবাই উদ্যোগ নেয়- তাহলে বিদ্যুত ব্যবহার সাশ্রয়ী হতে পারে।’

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী আছেন। এখানেও (সংসদে) আছে তাদের আমি তো স্পষ্ট বলেছি। গ্যাস আমি দিতে পারবো- কিন্তু যে মূল্যে গ্যাস আমরা বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসলাম সেই মূল্য যদি আপানারা দেন আমরা গ্যাস দিতে পারব। আমরা বাল্কের যেটুকু বাড়ানোর বাড়িয়েছি। তারা যদি নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চায় তাহলে যে মূল্যে কিনে আনব সেই মূল্য তাদের দিতে হবে। সেই মূল্যই তাদের দিতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এটা ভুলে যাবেন না, ভর্তুকির টাকা তো জনগণেরই টাকা। যত মূল্য কম থাকে, আমাদের বিত্তশালীরা লাভবান হন। যারা সাধারণ মানুষ, তারা ঠিকমত বিল দেয়। বিত্তশালীরা আরাম আয়েশ করবে আর স্বল্প মূল্যে পাবে তা কী করে হয়? সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা আমাদের পরিকল্পনা নিচ্ছি।’

এর আগে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেশে আলোচিত। এই ঋণ পেতে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। এই ঋণের কারণে ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঋণের কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। এতে করে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে উৎপন্ন পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। এই চাপ সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে।’

মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনে চুন্নু বলেন, ‘মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু পাকিস্তান সফরের পর তেহরিক-ই ইনসাফ পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। তিনি বাংলাদেশে আসার পরে অনেকে মনে করেছিলেন সরকারের কিছু একটা হবে। জানি না উনি যাওয়ার পরে সরকার মনে হয় খুব খুশি খুশি লাগছে। আবার একটি দল মনে হয় খুবই অখুশি। আমরা জাতীয় পার্টি এটাকে ওইভাবে নিচ্ছি না। এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছি। রাজনৈতিকভাবে বর্তমান যে অবস্থাটা- মানুষের মাঝে একটি গুঞ্জন আছে- র্অথনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে কিছু একটা কী যেন হয়। এ ধরনের কিছু আছে কী না? বিষয়টি পরিষ্কার গর্ভমেন্টের কাছ থেকে।’ এ পর্যন্ত বলার পর মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মাইক ছাড়াও আরও কিছু বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে মাইক চালু হলে বলতে শোনা যায়, ‘জাতি জানবে, সবার জন্য ভালো হবে।’ প্রধানমন্ত্রী অবশ্য চুন্নুর বক্তব্যের এই অংশের জবাব দেননি।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়ে কথা বলার সময় নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে কথা বলতে অস্থির লাগছে বলে জানান সংসদ নেতা। এসময় স্পিকার তাঁকে বসে বক্তব্য দেওয়ার পরামর্শ দিলে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য সংক্ষেপ করে বাকি অংশ পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকারের কাছে অনুরোধ করেন।

সর্দি জ্বরে আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি দলের এম আব্দুল লতিফের মৌখিক প্রশ্নের দীর্ঘ ১৭ পৃষ্ঠার জবাব দেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে গিয়ে তিনি কিছুটা অসুস্থবোধ করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার অস্থির লাগছে।’ পরে বসে উত্তর দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে অনুরোধ করেন। তবে তিনি বসে তাঁর বক্তব্যের বাকি অংশ পঠিত বলে গণ্য করার অনুরোধ করেন।

পরে আব্দুল লতিফ একটি সম্পূরক প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী আবারও দাঁড়িয়ে তার সংক্ষিপ্ত জবাব দেন। এ সময় স্পিকার সংসদ নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি বসেও বলতে পারেন।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলে, ‘এটা বলে শেষ করে দেব।’ ওই সময় তিনি ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা বলেন। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত ৩০ মিনিট সময় শেষ হয়ে যায়। যদিও এরপরে তিনি আবার অনির্ধারিত আলোচনায় দাড়িয়ে জাপা এমপি মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যের জবাব দেন।

চুন্নুর বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আবারও ফ্লোর নিয়ে বলেন, ‘একটু সর্দিকাশি হয়েছে বলে বেশি বলতে চাচ্ছিলাম না। আর ছাড়তেও চাই না। শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছিলাম। এই প্রশ্নের উত্তরটা না দিলেই নয়।’

এর আগে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দীর্ঘদিন করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।’ অন্যান্য সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংকটের আশংকা তৈরি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনেতিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে দেশে যেন খাদ্য সংকট সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post বিএনপির এ্যানি ও সালাম কারামুক্ত
Next post নিউইয়র্কে অভিবাসীদের জন্য জায়গা খালি নেই: মেয়র
Close