Read Time:4 Minute, 9 Second

ঘরবন্দি জীবন আমার কাছে নতুন নয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছি এই অপরাধে ইস্কুল কলেজের বাইরে পুরোটা কৈশোর জুড়ে ঘরবন্দি জীবনই তো কাটাতে হয়েছে। যৌবনেই বা কতটুকু আর স্বাধীনতা পেয়েছি। বাইরে যৌন হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ ওঁত পেতে আছে বলে ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমার লেখালেখিতে ইসলামের সমালোচনা ছিল বলে মৌলবাদিরা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করতো। বইমেলায় শারীরিক আক্রমণ করতো।

ওদিকে একের পর এক ফতোয়াও জারি হলো। মুণ্ডু কেটে নিতে পারলে লাখ টাকা উপহার। তখনও বাধ্য হয়েছি ঘরবন্দি জীবন কাটাতে। সরকার একসময় মামলা করলো, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলো। তখনও আত্মগোপন অবস্থায় আবারও ঘরবন্দি জীবন। নির্বাসন জীবন শুরু হলো ইউরোপে। সেখানেও অতি সুরক্ষার কারণে মেনে নিতে হলো ঘরবন্দি জীবন। বিদেশ ফেলে যখন ভাষার টানে কলকাতায় ঠাঁই নিয়েছি, সেখানেও একের পর এক ফতোয়া।

একসময় সিপিএম সরকার আমাকে রাজ্য ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কথা শুনিনি বলে আমাকে গৃহবন্দিত্ব উপহার দিল। আহারে সেইসব কষ্টের যন্ত্রণার দিনগুলি! কয়েক মাস ঘরবন্দি করে রাখার পর রাজ্য ছাড়তে শেষ অবধি বাধ্যই করলো। দিল্লিতেও কেন্দ্রীয় সরকার একই কাজ করেছিল, হয় ভারত ছাড়ো নয়তো ঘরবন্দি থাকো, বাইরে বলা হয়েছিল ‘সেইফ হাউজে’আছি। সেখানেও কেটেছে আরো কয়েকটি মাস।

এ কারণেই সম্ভবত একা একা একটি বাড়িতে দিন রাত পড়ে থাকা, বাইরের আলো হাওয়ার স্পর্শ না পাওয়া আমার কাছে খুব কিছু অস্বাভাবিক অসম্ভব নয়। বীন দেয়ার, ডান দ্যাটের মতো। টেনশান তখনও ছিল, এখনও আছে। পরাধীনতার ক্ষোভ ছিল, ফণা তুলে থাকা মৃত্যু ছিল চোখের সামনে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও অনুভূতিগুলো প্রায় একই। বাইরে বেরোলে ধর্ষকেরা, গ্রেফতারি পরোয়ানা হাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা পুলিশেরা, মুন্ডু কাটার জন্য অর্থলোভী ধার্মিকেরা, ফাঁসি দেওয়ার জন্য ধর্মান্ধরা সবাই আমাকে খুন করবে, ঠিক এখন যেমন ইমিউনিটি না থাকা শরীরটি বাগে পেলে করোনাভাইরাস আমাকে গলা টিপে হত্যা করবে।

ভাইরাসকে কি দরজা বন্ধ করে রাখলেই ঠেকানো যায়! ফাঁক ফোকড় দিয়ে কোনওদিন হয়তো ঢুকে যাবে, সাপ যেমন ঢুকে গিয়েছিল লখিন্দরের লোহার ঘরে। তবে যথাসম্ভব সতর্কই থাকতে চাই। চাই কারণ বিশ্বাস করি জীবন একবারই আসে, আর মৃত্যুতেই এই জীবনের সমাপ্তি, তাই এই জীবন বড় মূল্যবান। ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছে পরকালের জীবনটি মূল্যবান, এই জীবনটির ইতিতে তাই তারা তত কাতর হয় না।

জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। এ যাত্রা যদি বেঁচেও যাই, করোনা পরবর্তী পৃথিবী আমাদের আগের পৃথিবীর মতো যদি নাও হয়, তবুও যেন শেষ বিদায়ের আগে অন্তত বন্ধুদের হাত স্পর্শ করার, স্বজনকে আলিঙ্গন করার স্বাধীনতা পাই।

-তসলিমা নাসরিনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ থেকে

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post প্রবাসীদের জন্য আসছে ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা
Next post করোনা যুদ্ধে টনি ডায়েসের ‘প্রবাসী সন্তানের চিঠি’ ভাইরাল
Close