কাজী মশহুরুল হুদা :
(পূর্ব প্রকাশিত পর)
উপস্থিত সকলেই অনুষ্ঠান শেষে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলাম তৎকালিন কন্সাল জেনারেলের সঙ্গে। তিনি জানলেন, এ বিষয়ে কন্সুলেট অফিস আবেদন পত্র জমা দিতে পারবে না। কমিউনিটিকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে কন্সুলেট অফিস সর্ব প্রকার সহযোগিতা করবেন।
মমিনুল হক বাচ্চু একাই প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ৫০০ এর অধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করলেন। দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। ২৯ জুলাই ২০০৮, ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের কন্সুলেট অফিসে সকাল ১০টায় একত্রিত হওয়ার জন্য বলা হয়। সিটি হলে গিয়ে ৫০০ স্বাক্ষর ও সীমারেখার ডায়াগ্রাম সহ আবেদনপত্র জমা দিতে যাওয়া হবে।
কন্সুলেটে বসে আবেদনপত্র লেখা হলো। লিখলেন ড. মাহাবুব খান (বাফলার প্রতিষ্ঠাতা), সীমারেখা করা হলো, ভারমন্ট বুলেবার্ড (পূর্ব সীমারেখা) এবং ওয়েস্টার্ন বুলেবার্ড (পশ্চিম সীমারেখা) ও বেভারলি বুলেবার্ড (উত্তর সীমারেখা) এবং ছিকস স্ট্রীষ্ট (দক্ষিণ সীমারেখা)। আবেদন পত্রে একজন মূল স্বাক্ষরকারী থাকতে হবে, যিনি উক্ত এলাকায় বসাবাসকারী একজন। মজার বিষয় হবলো- কমিউনিটির যেসকল নেতৃবৃন্দ লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণের আবেদন পত্র জমা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছেন তাদের কেউই নামকরণ এলাকায় বসবাস করেন না এবং যাদের স্বাক্ষর জমা দেওয়া হচ্ছে তাদের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে কেউ কাজে গেছে অথবা রাতে কাজ করে এসে সকাল সকালে ঘুমাচ্ছেন।
সিটি হলে এ্যপয়েন্টমেন্ট করা আছে। যথা সময়ে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে ১২টায় অফিসে লাঞ্চের ছুটিতে সবাই চলে যাবে। ডা: আবুল হাসেম বললেন, তিনি একজনকে চেনেন যিনি সিকস এণ্ড ক্যাটালিনা সেভরণ গ্যাস স্টেশনে কাজ করেন। তার কাছ থেকে আবেদন পত্রে স্বাক্ষর নিয়ে সিটি হলে মিলিত হবেন। তিনি ও ভাইস কন্সাল শামীম আহমেদ চলে গেলেন স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। অপরদিকে, বাকী অন্যান্য সকলে চলে গেলেন সিটি হলে, তাদের মধ্যে ছিলেন- মমিনুল হক বাচ্চু, ড. মাহাবুব খান, শঙ্কু আইচ, মুজিব সিদ্দিকী, কুদ্দুস খান, ড. জয়নুল আবেদিন প্রমুখ। এই সময় আমি দূরে থাকায় যোগদান করতে পারিনি (লিটল বাংলাদেশ সংক্রান্ত সকল বিষয়ের এই একটি বিষয়েই আমি অনুপস্থিত ছিলাম)। ডা. হাসেম ও শামীম আহমেদ গেছেন আকতার মিঞার কাছে, লিটল বাংলাদেশ নামকরণের পিটিশনের স্বাক্ষর নিতে। তবে আকতার মিঞা এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি স্বাক্ষর দিতে ইতস্তত: করেন। যদি কোন সমস্যা বা বিপদে পড়েন সে জন্য। তিনি কন্সাল শামীম হোসেনকে বললেন, স্বাক্ষরের কারণে যদি বিপদে পড়ি তাহলে আপনারা আমাকে উদ্ধার করবেন? আমি বিপদে পড়লে তখন কমিউনিটির কাউকে পাওয়া যাবে না। ঠিক তখন শামীম হোসেন তাকে অভয় দিলে তিনি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর দেন। তিনি তখন ভাবতেও পারেননি যে- এই স্বাক্ষর তাকে অমর করে রাখবে। ডা: হাসেম এবং কন্সাল শামীম হোসেন সিটি হলে গেলেন যেখানে অপেক্ষা করছে করছে কমিউনিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সিটি ক্লাবের হাতে আবেদন পত্রের সাথে ৫০০ এর অধিক কমিউনিটির স্বাক্ষর এবং লিটল বাংলাদেশ সীমারেখার ডায়াগ্রামপত্র জমা দেওয়া হলো। কুদ্দস খান এই মুহুর্তকে তার মতামত ভিডিওতে সংরক্ষণ করলেন। যেটা একটা দূর্লভ ডকুমেন্ট।
অফিসিয়ালি আবেদনের পর কাউন্সিলম্যান টম ল্যাবাঞ্জ বাংলাদেশ কন্সুলেট অফিসে কন্সুলেট জেনারেল আবু জাফরকে চিঠি মারফত লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণের জন্য অফিসিয়ালি চিঠি পাঠান এবং তাতে উল্লেখ করেন তিনি বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটির প্রাণের দাবী পূরণে সর্বতভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন।
লিটল বাংলাদেশ নামকরণের জন্য আবেদনপত্র জমার খবর কোরিয়ান কমিউনিটির কানে যায়। তারা দেখলো যে- লিটল বাংলাদেশ নামকরণের জন্য যে সীমারেখা দাবী করা হয়েছে তা কোরিয়া টাউন নামকরণেরই অংশ। এটা অসম্ভব দাবী। ইতিমধ্যে উক্ত এলাকা কোরিয়া টাউনের অন্তভূক্ত। তারা কোরিয়ান কমিউনিটি সেন্টারে নেভারহুড কাউন্সেলে টাউন হল মিটিং এর ডাক দিলো। এই খবর বাংলাদেশ কমিউনিটির কাছে কোরিয়ান নিউজ মিডিয়া জানিয়ে দিয়ে বলে- আমরা যেন সেই টাউন হল মিটিং এ উপস্থিত থাকি। মিডিয়া চায় বিষয়টি গরম খবরে পরিণত হোক। আমরা সেই টাউন হল মিটিং এ উপস্থিত হলাম। আমি, মমিনুল হক বাচ্চু, শামীম হোসেন, কন্সাল শামীম আহমেদ, মুজিব সিদ্দিকী, ডা: হাসেম, ড. মাহবুব খান, কুদ্দুস খান উপস্থিত ছিলাম। কোরিয়ান কমিউনিটি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন চ্যাংলি। তিনি আমাদের বললেন- টাউন হল মিটিং এর পর আমাদের সাথে পরিচিত হবেন। টাউন হল মিটিং এ ইংরেজি ও কোরিয়ান ভাষায় তুমুল ঝড় বইতে লাগলো। তারা কোন মতেই আমাদের দাবী মেনে নেবে না। কারণ তারা এখানে আগে এসে কোরিয়া টাউন দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে তুলেছে। আমরা যেন অন্য কোথাও লিটল বাংলাদেশ নাম করণের জন্য চেষ্টা করি। টাউন হল মিটিং এর পর আমরা গোলটেবিল বৈঠকে বসে একে একে নিজেদের নাম সহ পরিচয় দিলাম। চ্যাং লি জানালেন, আমাদের সাথে কোন আলোচনায় বসবেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা পিটিশন তুলে নেব।
মাজার বিষয় হচ্ছে- সিটিতে অফিসিয়ালি নামকরণের একটা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি আছে। কোরিয়ান কমিউনিটি তাদের নামকরণে সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। ৬০ বছর ধরে কোরিয়া টাউন প্রতিষ্ঠিত করেছে অথচ পিটিশন জমা দেয়নি। ৫০০ কমিউনিটির স্বাক্ষরও জমা দেয়নি। অতএব, আইনের কাছে তারা গ্যাড়া কলে পড়ে গেছে। যার কারণে তারা আমাদের কাছে পিটিশন তুলে নেওয়ার দাবী জানাচ্ছে। আমরাও বুঝে গেছি, পিটিশনই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। পিটিশন তুলে নিলে আমাদের কোন শক্তি বা বল থাকবে না। আমরাও বলেছি- পিটিশন তুলে নেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র আলোচনা ও সমঝোতার পথ খোলা আছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে- কোরিয়ান কমিউনিটি লস এঞ্জেলেসে বিশাল শক্তিশালি। ব্যবসায়ীক দিক থেকে, আর্থিক দিক থেকে এবং জনসংখ্যার দিক থেকে। তারা বাংলাদশেী কমিউনিটির থেকে ১০ গুনেরও বেশি অধিক।
আমেরিকা আইনের দেশ। আইনের চোখে সবাই সমান। আমরা দেশের নিয়ম মোতাবেক আবেদন করেছি, তোমরা আইন মোতাবেক করনি। অতএব, দৃষ্টিতে আমাদের কেস ভ্যালিট।
কোরিয়ান কমিউনিটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, কারণ, এদেশের জনগনের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ব্যাবসায়িক মানুষের অনুদানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা কাউন্সেল ম্যান টম ল্যাবাঞ্চকে বলে দিল তুমি যদি ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণ প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকো আমরা তোমার সাথে নেই। কাউন্সেলম্যান বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ কন্সুলেট জেনারেল আবু জাফরকে আরেকটি চিঠি পাঠান। দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে- লিটল বাংলাদেশ নামকরণে তার সমর্থন তিনি তুলে নিলেন। তবে তিনি পলিটিশিয়ান, তিনি জানেন আমাদের দাবি আইন সঙ্গত। তাছাড়া নির্বাচনে অর্থের সাথে প্রয়োজন ভোট। কাউকেই অখুশি রাখতে চাইবেন না। মিষ্টি মুখে কাজ হাসিল করাই পলিটিশিয়ানদের কাজ।
কন্সাল জেনারেল আবু জাফর আমাদেরকে বললেন, এভাবে আমরা কাজ আদায় করতে পারব না। তারজন্য একটা কমিটি গঠন করতে হবে এবং সেই কমিটি কোরিয়ান কমিউনিটি ও সিটির সাথে ডিপ্লোমেটিক উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে। তিনি বলেন, কন্সুলেট অফিস কমিউনিটির কাজ করার এখতিয়ার নেই। কমিউনটির মধ্য থেকে প্রতিনিধি বানিয়ে তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। তিনি কন্সুলেট অফিসে কমিউনিটির মধ্যে থেকে কমিটি গঠনের জন্য মিটিং এর আহ্বান জানান। সকলেই উপস্হিত হয় কমিটি গঠনের মিটিংএ।
মিটিং এ ইশতিয়াক চিশতি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার জলিল খানের নাম উল্লেখ করেন। মুজিব সিদ্দিকী নিজেই নিজের নাম প্রস্তাব করেন কো-অর্ডিনেটর হিসেবে তিনি থাকতে চান। কুদ্দুস খান আমার নাম প্রস্তাব করেন। এই তিনজনকে নিয়ে ‘লিটল বাংলাদেশ’ কো-অর্ডিনেটর কমিটি গঠিত হয়। সর্বপ্রথম ইঞ্জিনিয়ার জলিল খানকে চীফ কো-অর্ডিনেটর ও মুবিজ সিদ্দিকী এবং আমি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে এই তিনজনার কমিটি হয় উক্ত প্রথম মিটিংএ।
( চলবে )।
পূর্বের সংবাদ (পর্ব-১) দেখতে ক্লিক করুন : https://probashbangla.info/2019/01/15/%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%9f%e0%a6%b2-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%af%e0%a7%87-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%b2%e0%a7%8b/
More Stories
মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্ট সেবা উদ্বোধন
মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্ট সেবার উদ্বোধন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরের সাউথগেটে অবস্থিত কমার্শিয়াল সেন্টারের আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের অফিসে এই...
লস এঞ্জেলেসে সপ্তম আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু সম্মেলন’র প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত
প্রবাস বাংলা ডেস্ক, লস এঞ্জেলেস থেকে, শামসুল আরিফীন বাবলু: ক্যালিফোর্নিয়া’র লস এঞ্জেলেসে ‘সপ্তম আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী...
এমভি আবদুল্লাহকে যেভাবে পাহারা দিচ্ছে ২ যুদ্ধজাহাজ
সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী। বাহিনীর...
লস এঞ্জেলেসে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২৪ উদযাপন
লস এঞ্জেলেসস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল যথাযোগ্য মর্যাদা, উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২৪ উদযাপন করে।...
মালয়েশিয়ায় সরাসরি পাসপোর্ট পেলেন দেড় হাজার প্রবাসী
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে সরাসরি পাসপোর্ট পেলেন দেড় হাজার প্রবাসী। শনি ও রোববার দেশটির ছুটির দিনে হাইকমিশনের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্রবাসী...
নিলামে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পেইন্টিং সোয়া চার কোটি টাকায় বিক্রি
সম্প্রতি নিউইয়র্কে এক নিলামে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুটি পেইন্টিং বা চিত্রকর্ম রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চিত্রকর্মটি...