Read Time:12 Minute, 51 Second

পর্ব -১
কাজী মশহুরুল হুদা।

২০০১ সালের পূর্বে বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে মূলধারার কোন সম্পর্ক ছিলো না। প্রবাসী বাংলাদেশী সকল উৎসব, সম্মেলন, অনুষ্ঠানাদি নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনই প্রথম সূচনা এবং সেতু বন্ধন। দেখা গেছে যখনই কোন কমিউনিটি মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার সৃষ্টি হয়েছে তারপর থেকে কমিউনিটির কল্যাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জন্য অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বলেছেন- ’বাংলাদেশের রাজনীতির ধোয়া তুলে কোন লাভ হবে না, ক্ষতি ছাড়া। বরং এদেশের মূল রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলে কমিউনিটি তথা দেশের জন্য অনেক মঙ্গল বয়ে আনবে। কিভাবে প্রথম কমিউনিটির সাথে মূলধারার ব্রীজ তৈরি হলো তার কথা দিয়েই শুরু করছি লিটল বাংলাদেশের কথা।
২০০১ এর ২৪ মে (শনিবার) মেমোরিয়াল ডে ইউকেন্ড শ্যাটো রিক্রিয়েশন সেন্টারে সাহিত্য সম্মেলন চলছে। হঠাৎ খবর হলো মেয়র পদপ্রার্থী এন্থোনিয়ও ভিলারোগাসা সাহিত্য সম্মেলনে কমিউনিটির উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলবেন এবং প্রবাসীদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য আসবেন। যোগাযোগের সূত্রে ছিলেন মোহম্মদ শামীম হোসেন।
মোহম্মদ শামীম হোসেনের কর্মময় জীবন বালটিমর হোটেল ডাউন টাউনে। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক উর্ধতন নেতৃবৃন্দ মিটিং করে থাকেন। সেই সুবাদে তার সাথে পরিচয় আছে অনেক মূলধারার পলিটিশিয়ান দের সাথে। পরিচয় হয় মেয়র পদপ্রার্থী এ্যান্থেনিও ভিলারোগোছার সাথে। তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটর সাথে পরিচিত হওয়ার আকাংখা ব্যাক্ত করেন নির্বাচনী প্রচারণার জন্য। যেহেতু সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে- তিনি তাকে কথা দিলেন। সাহিত্য সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন ড. রাহি এবং আমি ছিলাম সদস্য সচিব। মোহম্মদ শামীম ও মমিনুল হক বাচ্চু আলোচনা সাপেক্ষে ভিলারোগোছাকে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন সন্ধ্যাবেলা ভিলারোগোছা তার প্রাইভেট সেক্রেটারী লিলিয়ান প্রেরেজকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- তিনি হল ভর্তি প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেখে অবাক হয়ে যান। ভাবতেও পারেননি যে এতো লোক হবে। অভ্যার্থনা জানানোর জন্য দেশীয় স্টাইলে কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ তাকে ঘিরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে আফজাল চৌধুরী বাংলাদেশী স্টাইলে স্লোগান দেওয়া শুরু করে দেয়। ‘ভিলারোগোছা এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’। এ স্লোগান শুনে ভিলারোগোছা হতবাক হয়ে যায়। জীবনে এমনটা সে দেখেনি। এদেশের রাজনৈতিক প্রচারণায় বাংলাদেশীয় স্টাইলের কোন ধারাই নেই। স্লোগানে আফজাল চৌধুরী বলে বসলেন- ‘আমরা চাই, লিটল ঢাকা’। ইতিমধ্যে সে মঞ্চে উঠে পড়েছে। আমরাও সবাই তার সঙ্গে মঞ্চে উঠে পড়েছি। চলমান অনুষ্ঠান থেমে গেলো। সাইফুর রহমান ওসমানী তখন অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ভিলারোগোছা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন- ‘শুভ সন্ধ্যা। (এটা একটা এদেশেীয় নেতাদের প্রচারণার স্টাইল।’ বিভিন্ন ভাষাভাষি ও দেশ, জাতীর মানুষদের ভোট আদায়ে তাদের ভাষায় দু’চারটি বুলি দিয়ে শুরু করে। যাতে তাদের ভালোবাসা অর্জন করতে পারে। আসার আগেই শামীম হোসেনের কাছ থেকে এ ধরণের কিছু বাংলা শব্দ তার প্রাইভেট সেক্রেটারি লিলিয়ান লিখে রেখেছিলেন)।’
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হল ভর্তি মানুষের করতালিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো মুহুর্তের মধ্যে। তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রশংসা করেন। পিছন থেকে সোহেল রহমান বাদল উচ্চ স্বরে বলে ওঠেন- উই ওয়ান্ট ’লিটল ঢাকা’। তখন ভিলারোগোছা বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি লিলিয়ানের দিকে তাকালেন। লিলিয়ান তাকে বললেন- এরা লিটল টোকিওর মত একটি নামকরণ চাইছে। তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন- আমি যদি মেয়র হতে পারি, তাহলে তোমাদের ইচ্ছা পূরণ করব। মূলধারার প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে কমিউনিটির মানুষের কাছে উপস্থিত হলেন ভিলারোগোছা এবং নামকরণের প্রথম সূচনায় তিনিই রয়েছেন।
কোন পরিকল্পনা ছাড়াই হুজুগে দাবী চাওয়া হয়েছিল। কথাটার উৎপত্তি হয় আফজালের কাছ থেকে। শ্লোগান দিতে গিয়েই দাবী দাওয়া হিসাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে বেরিয়ে আসে। আফজাল ঢাকার পোলা , তাই তাৎক্ষনিকভাবে লিটল ঢাকা বলেই নামকরণ দাবী করে বসেছিলেন। তথাপি পরবর্তী কালে কমিউনিটি নামকরণকে লিটল বাংলাদেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইবারের নির্বাচনে এন্থোনিও ভিলারোগোছা জিততে পারেনি। মেয়র হয়েছিলেন জিম হান। কিন্তু ভিলারোগোছা হাল ছাড়েনি। চার বছর পর আবারও তিনি মেয়র পদে দাঁড়ালেন। এবার তিনি ঠিকই জিতে গেলেন। মজার বিষয় হচ্ছে- তিনি প্রতিশ্রুতির কথা ভোলেননি। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির কথা ডেমোক্রেটিক পার্টির সকলের কাছে ব্যাপক ভাবে প্রচার করলেন। ফলে মূলধারার নেতৃবৃনদের নজর বাংলাদেশ কমিউনিটির দিকে পড়ে। পরবর্তী নির্বাচনের সকল পদপ্রার্থী বাংলাদেশী কমিউনিটির স্বরণাপন্ন হতে শুরু করল। এই সেতু বন্ধন ও যোগসূত্র কমিউনিটকে মূলধারার মানুষের কাছাকাছি এনে দিল।
এন্থনিও ভিলারোগোসা লস এঞ্জেলেসে মেয়র হওয়ার পর ২০০৬ এর ৮ই আগষ্ট মুনা (মুসলিম উম্মা অব নর্থ আমেরিকা’র ক্যালিফোর্নিয়া শাখা) তাদের বার্ষিক পিকনিকে গ্রিফিত পার্কে মেয়র ভিলারোগোসাকে আমন্ত্রণ জানায় এবং মেয়র পিকনিকে উপস্তিত হলে তার কাছে কমিউনিটির দাবী ‘লিটল বাংলাদেশ’ এর কথা উল্লেখ করা হয়। তখন মেয়র তার বক্তব্যে বলেন- ‘আই উইল সি’।

বিগত ৬ জুন ২০০৬ সালে লস এঞ্জেলেস কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে বাফলা (বাংলাদেশ ইউনিটি ফেডারেশন অব লস এঞ্জেলেস) প্রতিষ্ঠিত হয়। বাফলার উদ্দেশ্য ছিল প্রতি বছর দল, মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সকলে মিলে একটি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ডে প্যারেড’র আয়োজন করা। বাফলা প্রথম বাংলাদেশ ডে প্যারেডের আয়োজন করে ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল। এই প্যারেড বর্তমান লিটল বাংলাদেশের উপর দিয়ে হয়েছিল এবং প্রথম প্যারেড মার্শাল হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেয়র এন্থোনিও ভিলারোগোসা। সেই সময় মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল থার্ড স্ট্রীস্ট এণ্ড হারবার্ড রাস্তার সংযোগস্থলে (স্বদেশ রেস্টুরেন্টের পাশে)। জলিল খান মেয়রের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন। সেখানে উল্লেখ করে কমিউনিটির দাবী ‘লিটল বাংলাদেশ’ পূরণ করা হোক। প্রতি উত্তরে তিনি তার বক্তব্যে দাবী পূরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন।

এরপর ২০০৮ সালে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এ্যাম্বাসেডর হুমায়ূন কবির লস এঞ্জেলেসে এসে মেয়রের সাথে দেখা করেন। সাথে ছিলেন তৎকালীন লস এঞ্জেলেস কন্সুলেটের ভাইস কন্সাল শামীম আহমেদ। সেই সময় এ্যাম্বাসেডর মেয়রকে প্রবাসী কমিউনিটির দাবী ‘লিটল বাংলাদেশ’র কথা উল্লেখ করেন এবং ঢাকা কে সিস্টার সিটি অব লস এঞ্জেলেস করার কথা বলেন। তখন মেয়র তাকে বলেন সিস্টার সিটি অব লস এঞ্জেলেস আমার আওতাধীন নয় তবে ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণ বিষয়টি চেষ্টা করব।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশী আমেরিকান নাফিস বিনজাফর প্রথম বাংলাদেশী হলিউড একাডেমী অস্কার এওয়ার্ড পেয়েছিল। আমরা ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লস এঞ্জেলেসে (দেশী রেস্টুরেন্টের পাশে, দোতালায়) বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টার ছিল, সেখানে নাফিসকে সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কন্সাল জেনারেল আবু জাফর। তিনি তার বক্তব্যে জানান, তার সাথে সেই দিন মেয়রের সাথে কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল, তিনি বলেছেন- সিটি নতুন কিছু নীতিমালা প্রনয়ন করেছে সিটির নামকরণের জন্য। লিটল বাংলাদেশ- নামকরণের জন্য আবেদন করতে বলেছেন। আবু জাফর জানালেন, আবেদন পত্রে এলাকায় বাসবাসরত কমপক্ষে ৫০০ কমিউনিটির স্বাক্ষর থাকতে হবে এবং ডায়াগ্রাম করে নিদৃষ্ট সীমারেখা জমা দিতে হবে।
উপস্থিত সকলেই অনুষ্ঠান শেষে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলাম তৎকালিন কন্সাল জেনারেলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে কন্সুলেট অফিস আবেদন পত্র জমা দিতে পারবে না। কমিউনিটিকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে কন্সুলেট অফিস সর্ব প্রকার সহযোগিতা করবেন।
মমিনুল হক বাচ্চু একাই প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ৫০০ এর অধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করলেন। দিনক্ষণ ঠিক করা হলো, ২৯ জুলাই ২০০৮।
ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের কন্সুলেট অফিসে সকাল ১০টায় একত্রিত হওয়ার জন্য বলা হয়। সিটি হলে গিয়ে ৫০০ স্বাক্ষর ও সীমারেখার ডায়াগ্রাম সহ আবেদনপত্র জমা দিতে যাওয়া হবে।
(ক্রমশ:)।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post সিএমএইচে ভর্তি এরশাদ
Next post যুক্তরাষ্ট্র আ.লীগের সাথে কাজ করার ঘোষণা দিল ক্যালিফোর্নিয়া আ.লীগ
Close