Read Time:10 Minute, 0 Second

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে যে পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে তা হিসাব করলে গড়ে প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলার হয়। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে এর প্রকৃত হিসাব কোথাও নেই বলে মনে করেন তিনি। শনিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে ‘ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম’ ও ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ আয়োজিত একটি সেমিনারে তিনি এসব কথা জানান।

আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে অর্থ পাচার হয়েছে অভিযোগ করে ড. ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংক খাত থেকে যে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বলেছেন, বাস্তবে তার পরিমাণ আরো বেশি। তৎকালীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা ব্যাংক খাত ও বাণিজ্যের আড়ালে বছরে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হলেও প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল জানিয়ে তিনি বলেন, যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে সেই দেশের সঙ্গে আইনি চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে অর্থ পাচার ও দুর্নীতি বন্ধ হবে না বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আহ্বানও জানান ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, অর্থ পাচার রোধে রাষ্ট্রকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। আগামী দুই বছরের মধ্যে যদি একটা পয়সাও ফেরত আসে তাহলে সেটাও বড় অর্জন হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি যারা চালু করেছে, সেই প্রভাবশালীরাই পাঁচতারকা হোটেলে বসে ব্যাংকখাতের নীতি পলিসি তৈরি করতো। বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব পলিসি শুধু ঘোষণা করত।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা—এই ত্রিমুখী আঁতাত মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। সব প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘ সময় ধরে দলীয়করণের চর্চা হয়েছে; গত ১৫-১৬ বছরে যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি। এতে আমলাতন্ত্রকে কর্তৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি আর তা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্সিকে। ফলে এসব জায়গায় কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি, তা যেন টেকসই হয়।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি দৃষ্টান্ত আছে। সেটি হলো, সিঙ্গাপুর থেকে। দেশটি থেকে ২০০৭ সালে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৯৩০ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব, যদিও তা অনেক কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, ওই সব দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশগুলোর সহযোগিতার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, অর্থ পাচার বন্ধে সাপ্লাই (যে দেশ থেকে পাচার হয়) ও ডিমান্ড (যে দেশে পাচার হয়)—উভয়ের মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ থাকতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন দেশে বিশেষজ্ঞদের সিন্ডিকেট আছে। সে কারণে আমরা একজন সাবেক মন্ত্রীর কয়েকটি দেশে কয়েক শ অ্যাপার্টমেন্টের বিষয়ে জানতে পারছি। কিন্তু এই ঘটনা বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র, এমন পাচারকারী আরো অনেকে আছেন। ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, অর্থ পাচার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, বিএফআইইউ—এসব প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার পথনকশা আছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে, শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু আইনেরও প্রয়োজন আছে। এছাড়া দুর্নীতি বন্ধে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন- ওয়েস্ট সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া এবং আর্থিক অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করায় এখন গুরুত্ব দিতে হবে। এসব উদ্যোগ নিলে পাচার হওয়া টাকার পুরোটা না হলেও কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এতে ভবিষ্যতে পাচার করার বেলায় সবাই সাবধান হয়ে যাবেন। আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ স্থানান্তর ও অর্থ পাচার—উভয় পদ্ধতিতেই দেশ থেকে অর্থ সরানো হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়। অনুমান করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার পাচার করা হয়েছে।

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আইএমএফসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার দেয়া ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা ছিল না, ঋণ দিলে সে অর্থ জনগণের কাজে আসবে না—এসব জানা সত্ত্বেও আইএমএফ সরকারকে কেন ঋণ দিয়েছিল, সে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। এসব ঋণের টাকা শুধু অপব্যবহারই হয়নি, তা দিয়ে সরকার গুলি কিনেছে, বারুদ কিনেছে ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করেছে। গত সরকারের সময়ে বিভিন্ন উৎস থেকে যত ঋণ নেওয়া হয়েছে ও ব্যয় করা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন তদন্ত করার দাবি জানান তিনি।

অর্থনীতিবিদ নাঈম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক হাইজ্যাক (ছিনতাই) হয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে কীভাবে। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সবার আগে মানসিকতা ঠিক করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাবশালীরা পাচার করা অর্থ হজম করে ফেললে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। সে জন্য পাচারকারীদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাচারের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ছাত্র-জনতার বীরত্বকে ব্যর্থ করার চেষ্টা হচ্ছে: সলিমুল্লাহ খান
Next post মেট্রোরেলে আগুন ও পুলিশ হত্যা নিয়ে বক্তব্যে তোলপাড়, সমন্বয়ক হাসিবকে শোকজ
Close