সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শুধু জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর (প্রোপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি চালুর বিষয়ে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে প্রস্তাবটি নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও সমমনা ৬টি দল ও জোট এ পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংসদের উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষ দুই জায়গায় পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনের এ পদ্ধতি সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আটকে যেতে পারে।
দেশে প্রথম ভোট সর্বোচ্চ (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট) পদ্ধতি চালু রয়েছে। একটি আসনে যে দলের প্রার্থী অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পান সেই দলের প্রার্থী জয়ী হন। একই ভাবে যেই দলের প্রার্থী বেশি আসন পান, সেই দল সরকার গঠন করে। বিগত নির্বাচনগুলোতে এভাবেই ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে আলোচিত পিআর বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পাবে। অর্থাৎ কোনো দল নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট পেলে ওই দল জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পাবে। নির্বাচনে এই পদ্ধতি চালুর পক্ষে জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন। যদিও বিএনপি এর ঘোর বিরোধিতা করছে। দলটি মনে করছে, এ পদ্ধতি চালুর নামে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি এ পন্থায় আসন বাড়ার পথ তৈরি করতে চায় ছোট দলগুলো।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ২৯ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ এবং পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রস্তাবে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব একীভূত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমানে উপস্থাপন করে। সেখানে জাতীয় সংসদ নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ-এই দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নিম্নকক্ষে বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ-সদস্য নির্বাচনের বিধান বহাল রাখা হয়েছে। তবে সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা এবং শুধু নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর উচ্চকক্ষে ১০০ প্রার্থী মনোনীত হবেন রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হারে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা অর্থ বিল বাদে সব ধরনের আইন প্রণয়নে পর্যালোচনা ও পরামর্শ দিতে পারবেন। সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি এবং যুদ্ধ ঘোষণাসংক্রান্ত বিল নিম্নকক্ষের সঙ্গে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকবে। ওই দিন বৈঠকে সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতা নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন অবান্তর ধারণা বলে মত দেন বিএনপির নেতারা। তারা নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন নির্ধারণের দাবি জানান।
ওই মত সমর্থন করে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও লেবার পার্টি। পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করে ১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে ওঠতে পারে কিনা তা সব রাজনৈতিক নেতাকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব।
তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে আবার দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা সবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। নিত্যনতুন ইস্যু সামনে আনলে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
এনসিপি, নাগরিক ঐক্যসহ বেশিরভাগ দল ওই দিনই ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যদি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হয়, তাহলে এটি নিম্নকক্ষের ‘রেপ্লিকা’ হবে। আর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হলে সেটার কোনো মানে হয় না। আর উচ্চকক্ষের ক্ষমতা না থাকলে সেটার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা উচ্চকক্ষের পাশাপাশি নিম্নকক্ষেও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব করেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন মতবিরোধ থাকলে সংস্কার বাস্তব মুখ দেখবে না বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতি চালু হলে তা হবে নতুন। যদিও এই আলোচনা অনেক আগে থেকেই রয়েছে। এতে ভোটের অপচয় কম হয়। ভোটারদের কাছে দল দায়বদ্ধ থাকে। তবে এ পদ্ধতির ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এ কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতি যতদিন পরিবর্তন না হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হবে ততদিন এ পদ্ধতি কার্যকর করা কঠিন হবে।
More Stories
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল অনুরোধ পূরণ করছে সরকার: প্রেস সচিব
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত তার পরিবারের সকল অনুরোধ অন্তর্বর্তী সরকার পূরণ করছে বলে জানিয়েছেন...
জুলাই আন্দোলনে নিহত ১৮২ মরদেহ উত্তোলন শুরু রোববার
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা অজ্ঞাত ১৮২ শহীদের মরদেহ উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে রোবিবার (৭ ডিসেম্বর)।...
ভারতে হাসিনার অবস্থান নিয়ে জয়শঙ্কর বললেন— সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লিতে অবস্থান করা নিয়ে মুখ খুলেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী...
কেউ যেন আমাদের ওপর কোনো দাদাগিরি করতে না আসে: ডা. শফিকুর
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা ভয় করি শুধু আল্লাহ তায়ালাকে। বাকি যাদের কথা বলেন, তাদেরকে আমরা...
পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে যাবে: প্রণয় ভার্মা
বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আরও এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয়...
ছাত্রশক্তির নেত্রী জেদনীকে বিয়ে করলেন এনসিপির হান্নান মাসউদ
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–এর সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বিয়ে করেছেন জাতীয় ছাত্রশক্তির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামলী...
