Read Time:9 Minute, 23 Second

আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরে চীন লাল গালিচা বিছিয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে এই আকর্ষণীয় সফর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের

ঢাকার তথ্য অনুযায়ী, ইউনূস ২৭ মার্চ চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেবেন।

পরের দিন বেইজিংয়ে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। পরে তিনি মর্যাদাপূর্ণ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন। সেখানে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হবে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ দলের অন্যান্য নেতাদের নয়াদিল্লিতে আশ্রয় দেওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। এরপর গত জানুয়ারিতে ভারত তাদের প্রায় ৪১০০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ পুনরায় শুরু করার পর সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। ১২ জানুয়ারি ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্যদিকে ভারতও পরের দিন একই পদক্ষেপ নেয়।

উত্তেজনার সর্বশেষ উৎস হলো মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য। যিনি ঢাকার নতুন প্রশাসনের অধীনে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ভারতের দাবির প্রতিধ্বনি করেছেন।

সোমবার নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল এনডিটিভির সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে গ্যাবার্ড বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, হত্যা… মার্কিন সরকারের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

ইউনূসের অফিস তার মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ বা অভিযোগের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। এটি একটি গোটা দেশকে অন্যায়ভাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের অনাবাসী সহযোগী আনু আনোয়ার বলেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন হিসেবে যারা ইতিমধ্যেই আগাম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে, তাদের অবশ্যই বেইজিংকে বোঝানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে যে, তারা একটি নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক অংশীদার।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট বলছে, ইউনূসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চীনা বিনিয়োগ নিশ্চিত করাও এজেন্ডায় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২০০৬ সালে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। গত বছর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ২২.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল চীনা রপ্তানি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগদানকারী প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশ এবং বৈশ্বিক সংযোগ কর্মসূচির অধীনে চীনা বিনিয়োগের একটি প্রধান গ্রাহক হয়ে ওঠে।

চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে জড়িত, বিশেষ করে পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক এবং কর্ণফুলী টানেল। ঢাকা এখন বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলা বন্দরের সম্প্রসারণের জন্য চীনা ঋণ চাইছে।

গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগের জন্ম দেয়, যার মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বকেয়া ঋণও রয়েছে। আনু আনোয়ার বলেন, ইউনূস বেইজিংকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করবেন যে, অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং কৌশলগত সম্পৃক্ততা সুরক্ষিত রয়েছে।

চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান স্টাডিজ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক লিন মিনওয়াং বলেন, ইউনূস বেইজিং সফরের সময় হাসিনার সই করা কিছু চুক্তি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। অনেক পরিকল্পিত সহযোগিতা আটকে আছে এবং আমি মনে করি চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন পুনরায় শুরু করার সময় এসেছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেইজিং-ঢাকার সম্পর্ক ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন অক্টোবরে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের পাশাপাশি আন্দোলনের প্রতিনিধিদের আতিথ্য দেন এবং তারপর থেকে তিনি ইউনূসসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের পাশাপাশি সামরিক ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের একটি মেডিকেল প্রতিনিধি দল দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুনমিং শহর পরিদর্শন করে। কারণ, ভারত বাংলাদেশি রোগীদের জন্য তার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবার বিকল্প সরবরাহকারীর সন্ধান করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ইউনূসের সফরে তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার আলোচনা কেবল প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক বিষয় নয় বরং রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪টি নদী রয়েছে, যার বেশিরভাগই ভারত থেকে উৎপন্ন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের চতুর্থ দীর্ঘতম তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য ঋণের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। বিষয়টি পরবর্তীতে নয়াদিল্লির নজরে পড়ে। তারপর থেকে তিস্তা প্রকল্পে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। যদিও বেইজিং বারবার এই প্রকল্পে ভারতের সঙ্গেও সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তবে ভারত প্রস্তাব দেয় যে, প্রকল্পটি তারা করবে।

এই প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদাহরণ। যেখানে উভয় দেশই বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করছে।

অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিনের ভাষ্য, তিস্তা প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারত-চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিরোধের বিষয় ছিল। অতএব যদি এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়, তবে আঞ্চলিক কৌশলগত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এটি বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন হবে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post দুদকের অভিযোগকে ‘মিথ্যা’, বললেন টিউলিপ
Next post হাসিনা পালানোর পর রাসেলস ভাইপারও চলে গেছে : শেখ বশিরউদ্দীন
Close