Read Time:13 Minute, 51 Second

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের একদফা দাবি এবং ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা সংসদে আইন পাশ করে স্থায়ী সমাধান ছাড়া রাজপথ ছাড়বেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন। শনিবার সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে প্রতিনিধি বৈঠক হবে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো কার্যক্রম বরদাশত করা হবে না বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।

একই দিন রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রক্টরের অপসারণ এবং হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের অব্যাহতি দিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও বগুড়ায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।

দেখা যায়, বিকাল সাড়ে ৩টার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে সোয়া ৪টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু হয়। এসময় মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে বিকাল সোয়া ৫টায় শাহবাগে যান। শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিলে পুলিশ চার পাশে লোহার বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ হয়ে মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেটগামী গণপরিবহণকে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হয়েছে। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ অসুস্থদের বহনকারী যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করেছে। ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও শাহবাগে মিছিল ও সমাবেশে যোগ দেন।

শাহবাগে সমাবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, বৃহস্পতিবার সারা দেশে আমাদের আন্দোলন চলাকালে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলা হয়েছে। এর মাঝে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। এতে অনেকেই আহত হয়েছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা চাই এই কোটার একটি যৌক্তিক সমাধান হোক।

শিক্ষার্থীরা এ সময় ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক-মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘সারা বাংলায় খবর দে-কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘জেগেছে রে জেগেছে-ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ইত্যাদি স্লোগান দেন।

আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক আবু সাইদ বলেন, আমাদের যৌক্তিক আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভাই-বন্ধুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছি কিন্তু পুলিশ সেখানে হামলা করেছে। এর প্রতিবাদেই আমরা সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, সারা দেশে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয়েছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। পুলিশ এক সাংবাদিককে লাঠি দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমরা এ হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।

জবিতে বিক্ষোভ মিছিল : বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বিকাল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন। এতে সদরঘাট এলাকার আশপাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবি জুম্ম শিক্ষার্থীদের : সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন জুম্ম শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার বিকাল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সংকট রয়েছে। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তারা সমান সুযোগ সুবিধা পান না। অনেক চড়াই উতরাই পার করে তাদের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তারা সমাজের অনগ্রসর। তাই সরকারি চাকরিতে তাদের ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখা যৌক্তিক।

আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে আন্দোলন দমাতে চায় সরকার-ইসলামী আন্দোলন : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম বলেছেন, সরকার এখন ভারসাম্যহীন আচরণ করছে। সরকার আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে কোটাবিরোধী আন্দোলন দমাতে চায়। শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের নিন্দা : কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি ‘সময় টিভি’র সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবসময় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আমাদের প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের আচরণও ছিল একইরকম সৌহার্দ্যরে। এই পারস্পরিক সুসম্পর্ককে নষ্ট করার চেষ্টা কিছু অতি উৎসাহীর দ্বারা হয়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কখনোই সমর্থন করে না। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এ নিন্দা জানায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : বিকাল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের প্যারিস রোড হয়ে বিভিন্ন আবাসিক হল ঘুরে স্টেশন বাজার এলাকায় যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করেন। এতে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার স্থানকে ‘ছাত্র আন্দোলন চত্বর’ নামে ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার প্রতিবাদ মিছিল থেকে চত্বরটির নামকরণ করা হয়। এ সময় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রক্টরের অপসারণ এবং হামলায় অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়।

ময়মনসিংহ : বিকাল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নগরীর গাঙ্গিনার পাড় মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। আনন্দমোহন সরকারি কলেজ, গভর্নমেন্ট কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষার্থীরা বিকাল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ ম্যুরালের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

জাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মশাল মিছিলটি শুরু করেন। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহিদ মিনারে এসে শেষ হয়।

দুমকি (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টায় টিএসসি থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু করেন। লেবুখালী-বাউফল সড়ক দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে জয় বাংলার পাদদেশে মিছিলটি শেষ হয়।

বেগমগঞ্জ (নোয়াখালী) : বিকাল ৪টায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাব হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : শুক্রবার জনসমুদ্রে রূপ নেয় চট্টগ্রামের কোটাবিরোধী আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের কলেজগুলো থেকেও বিপুল শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। চবি শিক্ষার্থীরা ষোলশহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার লংমার্চ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

বগুড়া : বিকালে শহরের সাতমাথায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে হয়েছে। এতে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ, সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজ, সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের আহ্বান
Next post কোটা আন্দোলনকারীরা সড়কে নামলেই ‘কঠোর ব্যবস্থা’
Close