Read Time:15 Minute, 41 Second

দুই হাজার ষোল সালের মার্কিন নির্বাচন ছিল একটি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা এবং আমেরিকার স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুতি, এমন যে একটা ভুল ধারণা অনেকের মনে রয়েছে, ২০২০ সালের নির্বাচন চিরদিনের জন্য তার কবর রচনা করুক।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সাত কোটি ভোট পেয়েছেন, যা আমেরিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট।

পুরো দেশে মোট ভোটের ৪৭ শতাংশের বেশি পেয়েছেন ট্রাম্প। মনে হচ্ছে, ২৪টি রাজ্যে তিনি জয় পেয়েছেন – তার প্রিয় ফ্লোরিডা এবং টেক্সাস অঙ্গরাজ্যসহ।
আমেরিকায় তার একটা ভিন্ন ভাবমূর্তি আছে যা দেশজুড়ে ছড়িয়ে, অনেকেই তাকে ভক্তি করেন।

হোয়াইট হাউজে তার চার বছরে ট্রাম্পের সমর্থকেরা তাঁর প্রেসিডেন্সির নানা বিষয় খুটিয়ে দেখেছেন এবং অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে তার সব শর্ত মেনে নিয়েছেন।

আজ ২০২০ সালে, ট্রাম্পের যে কোনো রাজনৈতিক দুর্বলতার বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক শক্তির বিষয়টিও আলোচনায় আসবে।

তবে সেটা যাই হোক, ট্রাম্প হেরেছেন, এবং তিনি আধুনিক যুগের সেই চারজনের একজন যারা দ্বিতীয় মেয়াদে জিততে পারেননি।

শুধু তাই নয়, তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো পপুলার ভোটে হারা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

২০১৬ সালে ট্রাম্প জিতেছেন, কারণ তাকে মনে করা হতো তিনি প্রথা ভেঙ্গে রাজনীতির বাইরে থেকে আসা একজন, এবং তিনি এমন কিছু বলার সাহস রাখেন যা অন্য কেউ কখনো বলেনি।

কিন্তু এটাও বলা যায় যে ২০২০ সালে ট্রাম্প হেরেছেন, কারণ তিনি রাজনীতির বাইরে থেকে উঠে আসা একজন, যিনি এমন কিছু বলতে প্রস্তুত ছিলেন যা আগে কেউ বলতে পারতো না।

এটা তার সেই ব্যাপক নিন্দিত দম্ভের মতো, ট্রাম্প যদি নিউইয়র্কের ফিফথ্‌ অ্যাভিনিউতে কাউকে গুলি করতেন, তবুও হয়তো তার বেশিরভাগ ভক্ত তাকে ভোট দিতেন।

কিন্তু যারা চার বছর আগে তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের একটা অংশ আবার ট্রাম্পের মারমুখো আচরণের কারণে এবারে পিছপা হয়েছেন। এটা বেশি সত্যি শহরতলীর ক্ষেত্রে।

জো বাইডেন তার আগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ৩৭৩টি শহরতলীর কাউন্টিতে ভালো করেছেন। আর এটা তাকে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিনে হার থেকে বাঁচিয়েছে, আর জয় এনে দিয়েছে জর্জিয়া এবং অ্যারিজোনায়।

শহরতলী এলাকায় নারীদের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প সুবিধা করতে পারেননি।

২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আমরা যা দেখেছি, তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

উচ্চ শিক্ষিত রিপাবলিকান, যারা চার বছর আগে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, তারা তাকে আবারও একটা সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন – যদিও তিনি ঠিক প্রেসিডেন্টসুলভ ছিলেন না। তারা জানতেন যে ট্রাম্প ঠিক অন্যদের মতো হবেন না। কিন্তু যেভাবে তিনি একের পর এক প্রথা ও আচরণগত নিয়ম ভেঙ্গেছেন, তা অনেকের কাছেই ছিল আপত্তিকর।

তারা দুরে সরে গেছে তার মারমুখো আচরণের কারণে। বর্ণবাদী উত্তেজনায় তার ইন্ধন জোগানোর কারণে। অশ্বেতাঙ্গদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহার করে করা তার টুইটের কারণে। অনেক সময়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে নিন্দা করতে তার ব্যর্থতার কারণে।

আমেরিকার চিরাচরিত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেয়া, কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদীদের প্রশংসা করাও অনেকে ভালো চোখে দেখেনি।

“খুব স্থিতিশীল একজন প্রতিভা” হিসেবে নিজেকে জাহির করার মতো অদ্ভুত কিছু বিষয় যেমন ছিল, তেমনই তিনি মদত দিয়েছেন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে।

তিনি এমনভাবে কথা বলতেন, যেন তিনি একজন ‘ক্রাইম বস’ – তাকে অপরাধ জগতের নেতার মতো শোনাতো। যেমন নিজেরই সাবেক এক আইনজীবী মাইকেল কোহেনকে তিনি বর্ণনা করছিলেন ‘র‍্যাট’ বা ইঁদুর হিসেবে।

এরপর রয়েছে তার সেই আচরণ, যাকে ট্রাম্পের সমালোচকেরা তার গা-ছমেছমে কর্তৃত্ববাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং যা দেখা গেছে নির্বাচনের পর, যখন তিনি ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।

পিটসবার্গে আমি চাক হাওয়েনস্টেইনের কথা বলছিলাম নির্বাচনী প্রচারণার সময়। ২০১৬ সালে তিনি ছিলেন ট্রাম্প সমর্থক, এবারে তিনি ভিাট দিয়েছেন জো বাইডেনকে।

“মানুষ আসলে ক্লান্ত,” আমাকে বলছিলেন তিনি। “তারা সবাই দেখতে চান দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। তারা শালীনতা দেখতে চান। তারা চান এটা দেখতে যে ঘৃণা বন্ধ হয়েছে। তারা চান ঐক্যবদ্ধ জাতি দেখতে। আর এসবই জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়ে আসবে।”

ট্রাম্পের একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা হলো নিজের সমর্থনকে তিনি মূল ‘ট্রাম্প বেস’ বা নিজের কড়া সমর্থকদের বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি। এমনকি বেশ করে চেষ্টাও করেননি।

ট্রাম্প ২০১৬ সালে ৩০টি রাজ্যে জয় পেয়েছিলেন, তবে এমনভাবে তিনি শাসন করেছেন যেন তিনি কেবলমাত্র রক্ষনশীল, লাল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

গত ১০০ বছরে আমেরিকায় আর কোন প্রেসিডেন্ট এতো বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়াননি। আর যে ২০টি অঙ্গরাজ্য হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছিল, সেই সব নীল রাজ্যকে তিনি কাছে টানার চেষ্টাও করেননি।

দীর্ঘ চারটি বছর পর অনেক ভোটার এমন কাউকে চেয়েছেন, যিনি হোয়াইট হাউজকে অনেকটা প্রথা অনুযায়ী চালাবেন।

ট্রাম্পের শিশুসুলভ গালাগালি, খারাপ ভাষার ব্যবহার এবং অবিরাম দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে বিরক্ত ছিলেন তারা। চেয়েছিলেন এক ধরণের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক।

কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচন আবার ২০১৬ নির্বাচনের পুনরাবৃতিও নয়।

এবারে ট্রাম্প ছিলেন ক্ষমতাসীন, বাইরের কেউ নন।

এবারে তাকে তার কর্মকাণ্ডের সমর্থনে কথা বলতে হয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি, যা তিনি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি, এবং যে মহামারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত দুই লক্ষ ৩০,০০০’র বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জো বাইডেনকে দানব বানানো ছিল কঠিন – আরও অনেক কারণের মতো এই কারণেও ডেমোক্র্যাটিক কর্ণধাররা তাকে প্রার্থী হিসেবে পেতে উদগ্রীব ছিলেন।

এই ৭৭-বছর বয়সী মধ্যপন্থীকে আরও যে কারণে বেছে নেয়া হয়েছিল, সেই কাজও তিনি সমাধা করেছেন – রাস্ট বেল্ট নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের ভোট এনে দিয়েছেন তিনি।

ট্রাম্প কেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরেছেন? – এই প্রশ্নের চেয়েও মজার ও তর্কসাপেক্ষ প্রশ্ন হতে পারে ট্রাম্প ঠিক কখন হেরে গেছেন।

এটা কি ২০১৬ সালের নির্বাচনের পরপরই, যখন ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে অংশত প্রতিবাদ হিসেবে তাকে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তারা বিভ্রান্ত হওয়ার পর? তাদের অনেকে আশাই করেননি যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যাবেন।

না-কি এটা তার ক্ষমতায় বসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই – যখন তিনি “আমেরিকার হত্যালীলা” উদ্বোধনী বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বর্ণনা করেন এমন এক দেশ হিসেবে, যেখানে কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, শ্রমিকেরা চাকুরি হারিয়েছে, আর মধ্যবিত্তের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আর এর সবই তিনি বলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কত লোক হয়েছে এবং তিনি যে টুইটার ব্যবহার করবেনই – এসব বক্তব্যের আগেই।

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির প্রথম দিনের সূর্য ডোবার আগেই এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট পদ তাকে যতটা না বদলাবে, তারচেয়ে বরং অনেক বেশি তিনি প্রেসিডেন্ট পদকে বদলে দেবেন।

না-কি এটা আরও অনেক কিছুর সংমিশ্রন – একের পর এক কেলেঙ্কারী, দোষারোপ, নিজের স্টাফদের ডিগবাজী আর বিশৃঙ্খলা?

অথবা এটা করোনাভাইরাসের ফলাফল, তার প্রেসিডেন্সির পুরো মেয়াদের সবচেয়ে বড় সংকট?

করোনাভাইরাস আমেরিকায় আসার আগে ট্রাম্পের রাজনৈতিক সূচকগুলো ছিল বেশ শক্ত। তিনি অভিশংসন বিচার পার করেছেন, তার সমর্থন ছিল ৪৯ শতাংশ – এ যাবৎকালের মধ্যে যেটা ছিল সর্বোচ্চ।

একটা শক্তিশালী অর্থনীতি আর ক্ষমতাসীন থাকা – এই দুটো বিষয় একজন প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে সাধারণত সাহায্য করে।

যে কোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি প্রশ্নই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় – দেশ কি এখন চার বছর আগের তৃলনায় ভালো অবস্থানে আছে? কিন্তু এরই মধ্যে কোভিড এলো, সাথে এলো অর্থনীতির সংকট – ফলে ওই প্রশ্নের একটা ইতিবাচক উত্তর দেয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

তবে এটা বলাও ভুল হবে যে কেবল করোনাভাইরাসের কারণেই ট্রাম্প হেরে গেছেন।

প্রেসিডেন্টরা অনেক সময় জাতীয় সংকট মোকাবেলা করে শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যান। সংকট অনেক সময় অনেককে মহান বানিয়ে দেয়।

এটা সত্যি ছিল ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টের ক্ষেত্রে – তিনি গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা মোকাবিলা করে আমেরিকাকে যেভাবে উদ্ধার করেন, তাতে তিনি নিজেকে অপরাজেয় অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন।

একইভাবে, জর্জ ডব্লিউ বুশ ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর প্রাথমিক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাতে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে – যা তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হতে সাহায্য করে।

সুতরাং এটা বলা বাহুল্য নয় যে কোভিড আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শেষ করেনি, বরং তিনি যেভাবে এই সংকটকে মোকাবিলা করেছেন, তা-ই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে টিকে ছিলেন – যদিও তার সময়ে দেশটি ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকট, ১৯৩০-এর দশকের পর সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট, আর ১৯৬০-এর দশকের পর সবচেয়ে বিস্তৃত জাতিগত অশান্তির মধ্যে ছিল।

রিপাবলিকান পার্টিকে সমর্থন করে পরিচিতি পাওয়া ‘রেড’ আমেরিকা, আর তা্র প্রভাবে থাকা রক্ষনশীলদের একটি বড় অংশ চেয়েছিল যে তিনি আবার ক্ষমতায় আসুন।

আগামী দিনগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্প রক্ষণশীল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবেন। আমেরিকার রক্ষনশীলদের মধ্যে রেগানিজম যেমন প্রভাব বিস্তার করে আছে, তেমনই ট্রাম্পিজম-ও একই রকম একটা ব্যাপার হয়ে থাকতে পারে।

একজন প্রবল মেরুকরণকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি থেকে যাবেন, আর এমনও হতে পারে যে ২০২৪ সালে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন।

এই বিচ্ছিন্ন রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই ঐক্যবদ্ধ হয়নি, এই কারণেও নয় যে ট্রাম্পের ব্যাপারে এত বেশি সংখ্যক আমেরিকান ভিন্ন ভিন্ন আবেগ ধারণ করেন – সেটা ভক্তি থেকে শুরু করে চরম ঘৃণা পর্যন্ত।

তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি তার শেষ প্রথাবিরোধী প্রেসিডেন্টের কথা শুনে ফেলেছে কিংবা দেখে ফেলেছে। এর নিশ্চিত জবাব হলো – না।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যে কারণে ‘ওম্যান’ শব্দের সংজ্ঞা পরিবর্তন করল অক্সফোর্ড ডিকশনারি
Next post করোনার টিকাকে ৯০ ভাগ কার্যকর দাবি মার্কিন কোম্পানির
Close