Read Time:12 Minute, 59 Second

প্রায় ৫০ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার আজীবন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শেষমেশ হোয়াইট হাউসে আসীন হলেন জো বাইডেন। বর্ণবৈষম্য বিরোধী অভূতপূর্ব সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে এ ঘটনা ঘটল। সেই সঙ্গে এক মহামারির মধ্যেও, শতাব্দীতে এমন সংক্রমণ একবারই ঘটে।

নীতিবিরুদ্ধ ক্ষমতাসীন এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন বাইডেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে তৃতীয়বারের মতো প্রচেষ্টার পর সমূহ রাজনৈতিক বাধা পেরিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের দেখা পেলেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাখ লাখ ভোটকে পেছনে ফলে ইলেক্টোরাল কলেজ পরিসংখ্যানকে নিজের দিকে টেনে নিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন।

নির্বাচন শেষে ফলাফল নিয়ে যে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে বড় ধরনের সাংবিধানিক জটিলতার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক অঙ্গরাজ্যে, মাথা চড়া দিয়ে উঠছিল বড় ধরনের সহিংসতা। এর মধ্যে ফলাফল নিয়ে অনড় দুই পক্ষ। জয়ের পক্ষে কোনোভাবেই নিজের দাবি ছাড়তে রাজি নন ট্রাম্প। রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোটের কারণে ঝুলে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল।

তবে শেষ মুহূর্তে সব শঙ্কা কেটে যায়, নানা দুশ্চিন্তাকে পিছে ফেলে চূড়ান্ত বিজয় স্পর্শ করে ফেলেন বাইডেন, এগিয়ে যান আরও। প্রেসিডেন্ট হতে যেখানে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট প্রয়োজন, সেখানে ২৯০টি অর্জিত হয়ে যায় তিনি। ট্রাম্প পড়ে রইলেন ২১৪ পর্যন্ত। টান টান উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনে বাইডেনের জয়ের পাঁচটি কারণ বের করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

১. কভিড, কভিড, কভিড

সম্ভবত এটাই ছিল বাইডেনের জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, যেটির উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই মহামারি যুক্তরাষ্ট্রের ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে দেশটির রাজনীতিরও। ট্রাম্পও বুঝতে পেরেছিলেন নির্বাচনে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে করোনা মহামারি। তাই প্রচারণার শেষদিকে তার বক্তব্য ছিল, ‘সবকিছুই ভুয়া খবর। সবখানেই কভিড, কভিড, কভিড, কভিড।’

মার্কিন মিডিয়ার আগাগোড়া নজর ছিল করোনার উপরে, যার প্রতিফলন ঘটেছে সাধারণ ভোটারদের মনেও। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের ব্যর্থতা বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল। বিপরীতে মহামারিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন জো বাইডেন। মহামারি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের ভূমিকাকে ঘিরে এক জরিপে তার থেকে ১৭ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন বাইডেন।

বৈশ্বিক মহামারিতে যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

মহামারি ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়শই যেভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন, বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করেছেন, একদম হুট করে এলোমেলোভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এই বিষয়গুলো জো বাইডেন ক্যাম্প সফলভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে কাজে লাগিয়েছে।

২. ধীরগতির প্রচারণা

জো বাইডেন তার দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে ভুল বক্তব্য ও অসমীচীন কাজের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে প্রথম নির্বাচনী প্রচারণায় ভুলের কারণে নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রচেষ্টায় সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। এবার তৃতীয় প্রচেষ্টায় কম হোঁচট খাচ্ছিলেন, সেইসঙ্গে কোনোভাবে নিজেকে আলোচনা থেকে হারিয়ে যেতে দেননি। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই মিডিয়ার নজর কেড়ে রাখতেন বেশি। সেই সঙ্গে করোনা মহামারি, কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে গোটা দেশে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়ে উঠে জাতীয় ইস্যু।

এমন পরিস্থিতিতে বাইডেনের প্রচারণা দল এমন একটি কৌশল গ্রহণ করে, যেখানে তাদের প্রার্থীর প্রচার সীমিত করা হয়, প্রচারাভিযান রাখা হয় শান্তিপূর্ণ।

এর বাইরে এবার বাইডেন ক্যাম্প খুব হিসেব কষে এগিয়েছে। বাইডেনকে যতটা সম্ভব কম জনসম্মুখে আসতে দেখা গেছে। প্রচারণার গতি এমন ছিল যাতে প্রার্থী ক্লান্তি থেকে অসাবধানতাবশত কিছু না করে বসেন।

ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর প্রকাশ না করা নিয়ে খুব বেশি ছিল না মানুষ, যেহেতু একটি ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাদের। বাইডেনের এই পরিমিত প্রচারণা নিয়ে যদিও ট্রাম্প হাস্যরস করেছিলেন। কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রচারণা দল সতর্কভাবে এর থেকে দূরে ছিল এবং চাচ্ছিল, প্রেসিডেন্টের মুখ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করুক। শেষ পর্যন্ত সেটিই ঘটেছে।

৩. আর যেই হোক ট্রাম্প নয়

বাইডেন এ নির্বাচনকে ‘আমেরিকার আত্মার লড়াই’ বলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। গত চার বছরের বিশৃঙ্খল ও বিভাজনের পরিস্থিতিকে সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ট্রাম্পের বিপরীতে নিজের শান্ত নেতৃত্বকে প্রকাশ করেছিলেন বাইডেন।

১৮ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে আসা ফ্রান্স থেকে আগত থিয়েরি অ্যাডামস নামে এক ব্যক্তি এ বছর প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘একজন ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের মনোভাব দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।’

এ নির্বাচন যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে একজনকে বেছে নেয়া ছিল না। এটি হয়ে উঠেছিল, ট্রাম্পকে ফের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাওয়া না চাওয়ার একটি গণভোট।

মূলত বাইডেনের প্রচারণা টিম, ভোটারদের কাছে সহজ একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল, আমি ট্রাম্প নই। ট্রাম্প যেভাবে নাগরিকদের প্রতি মুহূর্তে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করতেন সেখান থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। যেখানে সফল হয়েছেন তিনি।

৪. মধ্যপন্থায় থাকা

ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ে বাইডেনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল বার্নি স্যান্ডার্সের মতো বামপন্থী নেতার সঙ্গে। এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো আর্থিকভাবে শক্ত এবং সুগঠিত প্রচারণার প্রার্থীও ছিল দলের মধ্যে বাইডেনের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বী।

তবে বাইডেন বরাবরই নিজেকে মধ্যপন্থায় রেখে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা নীতি ফিরিয়ে আনা, বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষা প্রদান এবং সম্পদের উপরে কর বসানো-বামপন্থী নেতাদের এমন প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও একমত ছিলেন না তিনি। যেটির প্রতিফলন ঘটে তার রানিংমেট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে মনোনীত করায়। তিনি চাইলে ডেমোক্র্যাট পার্টির বামপন্থীদের সমর্থনে থাকা শক্তিশালী কোনো নেতাকে তার রানিংমেট করতে পারতেন।

তবে পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যু নিয়ে স্যান্ডার্স এবং ওয়ারেনের নীতির কাছাকাছি ছিলেন, একই সঙ্গে কর্মসংস্থান নিয়ে নীতিও, যা তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার অন্যতম কারণ ছিল। জ্বালানি কেন্দ্রিক শিল্পের বিপরীতে পরিবেশগত ন্যায়বিচারকে সামনে এনেছিলেন তিনি। জলবায়ু নিয়ে সমাধান ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি তাকে আরও সামনে এগিয়ে দেয়।

৫. ফান্ড খরচে কৌশল

এ বছরের শুরুতে বাইডেনের ফান্ড বলতে গেলে ট্রাম্পের তুলনায় কিছুই ছিল না। যেখানে ট্রাম্প এক বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে নেমে গেছেন। তবে এপ্রিলের নাগাদ বাইডেনে ফান্ড সংগ্রহও বেশ শক্ত হয়ে উঠে। অক্টোবরের শুরুতে দেখা যায় ট্রাম্পের তুলনায় ১৪৪ মিলিয়ন ডলার বেশি অর্থ হাতে আছে বাইডেনের প্রচার দলের কাছে। ট্রাম্পের ফান্ড যেখানে অপচয় হচ্ছিল বেশি সেখানে কৌশলে অর্থ খরচ করেন বাইডেন। ব্যাটেলগ্রাউন্ডগুলোতে টিভি বিজ্ঞাপনে রিপাবলিকান সমর্থকদের নাস্তানাবুদ করে ফেলা হয়।

নির্বাচনী ফান্ড যে সবকিছু নয় সেটা ২০১৬ সালে প্রকাশ পেয়েছিল, যখন ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হিলারি ক্লিনটন ফান্ড সংগ্রহে এগিয়ে ছিলেন। তবে বাইডেন তার ফান্ড খরচ করেছেন কৌশলের সঙ্গে। মহামারির কারণে স্বাভাবিকভাবে মানুষ অনেক বেশি মিডিয়া নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ঘরে বসে মানুষদের কাছে নিজের বক্তব্য পৌঁছে দিতে মিডিয়া প্রচারণাকে কাজে লাগান তিনি।

ইলেক্টোরাল ভোট হিসেব করে ব্যাটেলগ্রাউন্ডে অর্থ খরচ করা হয়। কম ব্যবধানে পিছিয়ে থাকতে পারেন এমন অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে বেশি নজর দেন তিনি। জর্জিয়া, অ্যারিজোনাসহ আরও ব্যাটেলগ্রাউন্ডে সে সুফল পান বাইডেন।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post হার মেনে নিতে শ্বশুর ট্রাম্পকে বুঝিয়েছেন জামাই
Next post ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তনে ‘কার্যনির্বাহী আদেশে’ স্বাক্ষর করবেন বাইডেন
Close