ভারতের সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি এবং দেশটির বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের মানুষের কাছে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। ভিন দেশের একজন রাজনীতিবিদ হয়েও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে কয়েকজন ব্যক্তির সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল, প্রণব মুখার্জি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম – যে বিষয়টি তার নিজের লেখাতেই উঠে এসেছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল।
প্রণব মুখার্জির লেখা বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’। বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর তার কতটা প্রভাব ছিল, সে সম্পর্কে ধারণা পায় যায় এই বই থেকে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির নানা ঘটনা উঠে এসেছে তার এই বইতে। উঠে এসেছে বাংলাদেশর রাজনীতি প্রসঙ্গও।
২০০৭ সালে বাংলাদেশে যখন সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান। তখন প্রণব মুখার্জির সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল মইন ইউ আহমেদের।
‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান তার কাছে চাকরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন।
তিনি লিখেছেন, দু’জনের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক একটি আলোচনায় কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবার জন্য মইন ইউ আহমেদকে বলেছিলেন প্রণব মুখার্জি।
প্রণব মুখার্জি জানাচ্ছেন, মইন ইউ আহমেদের আশঙ্কা ছিল যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। কিন্তু মইন ইউ আহমদের চাকরির দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।
প্রণব মুর্খাজি বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে আশ্বস্ত করেন যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তার কোনো সমস্যা হবে না।
প্রণব মুখার্জির এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর সময় কেটে গেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টও হয়েছে। কিন্তু প্রণব মুখার্জির লেখা নিয়ে মইন ইউ আহমেদ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।
২০০৯ সালের জুন মাসে জেনারেল আহমেদ অবসরে যাওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হয়েছেন। এরপর তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানা যায়।
প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য তিনি মইন ইউ আহমেদকে সহায়তা করেছেন।
ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে অন্যতম নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রণব মুখার্জির কাছে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের চাকরির নিশ্চয়তা চাওয়ার বিষয়টি তার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে।
‘দুই বছর ধরে তিনি অঘোষিত পাওয়ারফুল ম্যান ছিলেন। তিনি সরাসরি এ ধরনের নিশ্চয়তা চাইবেন, ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে, সেটা আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে,’ বলেন ব্রিগেডিয়ার হোসেন।
অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা অবশ্য বিষয়টি একেবারে নাকচ করে দেননি।
‘মইন ইউ আহমেদ এই বক্তব্য রিফিউট করেননি। তিনি বলেননি যে, না এ ধরনের কথা হয়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে যে মইন ইউ আহমেদ এ ধরনের কথা বলে থাকতে পারেন।’
এছাড়া, ২০০৮ সালে কারাগারে আটক শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রণব মুর্খাজি এ কারণে দেখাও করতে চেয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে।
‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, তার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২০০৮ সালে কারাগারে বন্দী সব রাজনীতিবিদের মুক্তি দেয়া হয়েছিল এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। একজন সিনিয়র কংগ্রেস নেতা – এই পরিচয়ের বাইরেও প্রণব মুখার্জির সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক রাজনীতি ছাপিয়ে অনেকটা পারিবারিক হয়ে উঠেছিল।
প্রণব মুখার্জি মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে শোকবার্তা দিয়েছেন, তাতে তিনি মি. মুখার্জিকে ‘অভিভাবক এবং পারিবারিক’ বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বার্তায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যেকোনো সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন।’
প্রণব মুখার্জি তার ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ ইয়ারস বইয়েও শেখ হাসিনাকে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন।
২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে দল থেকে বাদ দিয়ে সংস্কারের চেষ্টা চালানো হয়।
মি. মুখার্জির বর্ণনা অনুযায়ী, সে সময় তিনি শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় বাংলাদেশ অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ করার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে ভারত।
শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতা তাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। যেসব আওয়ামী লীগ নেতা তখন শেখ হাসিনাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাদের সমালোচনা করেন প্রণব মুর্খাজি।
তিনি লিখেছেন, ‘আমি তাদের বলেছিলাম, কেউ যদি খারাপ অবস্থায় থাকে তখন তাকে ছেড়ে যাওয়া অনৈতিক।’
More Stories
দায়িত্ব নেওয়ার সময় নির্বাচন দেওয়ার কোনো শর্ত ছিল না : সাখাওয়াত হোসেন
দেশে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না, তা নির্বাচন কমিশনই বলতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার...
জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজন ও সহিংসতার রাজনীতি উসকে দিচ্ছে : এনসিপি
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভাজন, ঘৃণা ও সহিংসতার রাজনীতি উসকে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক...
আপাতত লন্ডন যাচ্ছেন না খালেদা জিয়া, আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স
সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে লন্ডনের হাসপাতালে নিতে কাতারের ব্যবস্থা করা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স মঙ্গলবার সকাল ৮টায় হযরত...
‘আমি ভালো আর সব খারাপ’— আওয়ামী আমলের এই প্রচার এখনো চলছে: তারেক রহমান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আমি ভালো আর সব খারাপ। এ রকম একটি বিষয় আমরা দেখেছি ১৬ বছর ধরে।...
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল অনুরোধ পূরণ করছে সরকার: প্রেস সচিব
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত তার পরিবারের সকল অনুরোধ অন্তর্বর্তী সরকার পূরণ করছে বলে জানিয়েছেন...
জুলাই আন্দোলনে নিহত ১৮২ মরদেহ উত্তোলন শুরু রোববার
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা অজ্ঞাত ১৮২ শহীদের মরদেহ উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে রোবিবার (৭ ডিসেম্বর)।...
