Read Time:10 Minute, 36 Second

বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী মারা গেছেন। গতকাল সোমবার রাতে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয় (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। 

অধ্যাপকের ভাগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘সোমবার রাত ২টার দিকে ঘুমের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ‘‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’’ হয়। ভোর ৪টার দিকে খালুকে স্কয়ার হাসপাতালে যখন নিয়ে গেলাম, ততক্ষণে সব শেষ।’ 

আজ মঙ্গলবার ভোরে জামিলুর রেজা চৌধুরীর জামাতা অধ্যাপক জিয়া ওয়াদুদও ফেসবুকে তার মৃত্যুর খবর জানান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী মৃত্যু পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন।

তিনি ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। একুশে পদক পাওয়া এই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে ২০১৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।

জামিলুর রেজা চৌধুরী একজন প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মাতা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পিতার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার শৈশবকাল কেটেছে। তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার সিলেটে ফিরে আসেন। এরপর তার পিতা বদলি হয়ে ময়মনসিংহে চলে যান।

তিনি ১৯৫৭ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।

কর্মজীবন

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলাফল প্রকাশের কয়েকদিন পর নিয়োগপত্র ছাড়াই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরকৌশল বিভাগে। এভাবেই তার শিক্ষকতা জীবন শুরু হল। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এই বৃত্তি বছরে একটাই দেয়া হতো। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল, কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে তিনি কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং বিষয়ের উপর পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

এরপর ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে কখনো বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, ডিন ছিলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ১৯৭৯ সালে ব্যাংককে UNESCAP- এ কয়েক মাস পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করতে হয়েছিল তাকে। 

বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো। যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা), বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ অধ্যাপক চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানী-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের একজন সদস্য। এছাড়া তিনি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত। সবশেষ তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

প্রকাশনা

দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অবদানের জন্য সমাদৃত জামিলুর রেজা চৌধুরীর ৬৯টি গবেষণা-প্রবন্ধ রয়েছে। 

পারিবারিক জীবন

তার স্ত্রীর নাম সেলিনা নওরোজ চৌধুরী; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক; বড় সন্তান (মেয়ে) কারিশমা ফারহিন চৌধুরী পেশায় পুরকৌশলী এবং ছোট সন্তান (ছেলে) কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী করেছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

একুশে পদক (২০১৭)
শেলটেক পুরস্কার (২০১০)
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক (১৯৯৮)
ড. রশিদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭)
রোটারি সিড অ্যাওয়ার্ড (২০০০)
লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক-৩১৫) স্বর্ণপদক
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি একটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ের ওপর এ ধরনের ডিগ্রি পেয়েছেন
জাইকা রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড

প্রসঙ্গত, খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সোমবার রাত ২টার দিকে ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।

অধ্যাপকের ভাগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, ‘সোমবার রাত ২টার দিকে ঘুমের মধ্যে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’হয়। ভোর ৪টার দিকে খালুকে স্কয়ার হাসপাতালে যখন নিয়ে গেলাম, ততক্ষণে সব শেষ।’

শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম জানান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আজ মঙ্গলবার ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। পরিবারের সদস্যরা মিলে সময় ঠিক করবেন।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post অক্সফোর্ডের করোনা ভ্যাকসিন কত দূর?
Next post সৌদিতে মোট মৃত্যু ১৫২ জনের মধ্যে ৫২ জনই বাংলাদেশি
Close