Read Time:13 Minute, 13 Second

কাজী মশহুরুল হুদা :

(পূর্ব প্রকাশিত পর)

এ অবস্থায় কোরিয়ান কমিউনটি দেখছে কার মাধ্যমে, কত কমের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা যায়। সে ক্ষেত্রে মুজিব সিদ্দিকীর প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। কারণ, মূল কমিটি যে দাবি করেছে তা পূরণ করলে কে-টাউনের আয়তনের দিক থেকে ক্ষতি হবে।  চ্যাংলি (কোরিয়ান কমিউনিটির একমাত্র প্রতিনিধি) মুজিব সিদ্দিকীর সাথে চুক্তিতে গেলেন এবং ওয়েস্টার্ণের পরিবর্তে নরমেন্ড থেকে ভারমন্ট অন থার্ডকে লিটল বাংলাদেশ নামকরণে রাজী হলেন। দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেলো চুক্তিতে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর প্রদানের। এই কথা মূল কমিটির নয়জন (মুজিব সিদ্দিকীকে নিয়ে ছিল দশজন) চ্যাংলি’র সাথে জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে জানায় যে- কমিউনিটির পক্ষে দশ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিই নামকরণের জন্য ওকালতি করছে। মুজিব সিদ্দিকী একা নয়। কোরিয়ান কমিউনিটি বিপাকে পড়ে গেল। কাদের সাথে বা কার সাথে চুক্তি নামা স্বাক্ষর করবে। দ্বিপাক্ষীক চুক্তি স্থগীত হয়ে গেলো এবং কাউন্সিলম্যানের অফিসে টম ল্যাবঞ্জের সাথে মুজিব সিদ্দিকী সহ আমরা ও কোরিয়ান কমিউনিটির প্রতিনিধি বৈঠকে বসলাম। কাউন্সিলম্যান টম ল্যাবাঞ্চ জানালেন, আমাদেরকে কোরিয়ান কমিউনিটির সাথে সমঝোতায় আসতে হবে। কোরিয়ান কমিউনিটি অভিযোগ করল ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামকরণ একটি অযৌক্তিক দাবি। কারণ কমিউনিটির তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান নেই, যার কারণে তারা দাবি করতে পারে।  

কাউন্সিলম্যান বললেন, যে এলাকাকে লিটল বাংলাদেশ করার জন্য দাবি করা হয়েছে তা তিনি দুই কমিউনিটির সাথে পদব্রজে তদন্ত করে দেখবেন। সবাই সমবেত হল থার্ড এণ্ড ভারমন্টের রালপাসের পার্কিং লটে। প্রচুর প্রবাসী কমিউনিটি সমবেত হয়েছে। কথা ছিল সীমিত সংখ্যক মানুষের অর্থাৎ শুধু মাত্র কমিটির সবাই থাকবে কিন্তু খবর ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ প্রবাসীরাও উপস্থিত হয়েছিল। আমরা দুপাশ দিয়ে হাটছি। ইব্রাহিমের বেঙ্গল লিটার স্টোর পড়ল প্রথমে। তারপর আমরা দেখালাম বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টারের ব্যানার যেখানে এক সময় কমিউনিটি সেন্টার ছিল কিন্তু পর্যবেক্ষণের সময় ছিল না। তবে ব্যানারটা তখনও ঝুলছিল। কয়েকটি ইন্ডিয়ান কমিউনিটির স্টোরকে প্রবাসী কমিউনিটি বলে দেখান হল। শেষে দেশী রেস্টুরেন্টে এসে থামলাম। কাউন্সিলম্যান হতাশ। বললেন, তোমাদের দাবী পূরণের জন্য এই কয়টা দোকান যথেষ্ট নয়। আমরা কাউন্সিলম্যানকে বোঝালাম যে, হয়তো ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট নয়, তবে দুই পাশের আবাসিক এলাকায় যত কমিউনিটির মানুষের বসত, ভোটের দিক থেকে যথেষ্ট। রাজনৈতিক জবাবে তিনি নিশ্চুপ। পলিটিক্যাল ম্যান, উভয়কেই খুশি করা তার উদ্দেশ্য। নির্বাচনে অর্থ এবং ভোট দুটিরই প্রয়োজন। তাই তিনি এবার এক পক্ষ অবলম্বন না করে দুই পক্ষকে খুশি করার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন।তিনি মুজিব সিদ্দিকী কতৃক প্রস্তাবিত এবং কোরিয়ান কমিউনিটি কতৃক মেনে নেওয়ার প্রস্তাবের উপর জোর দিয়ে দ্বিতীয় দফা মিটিং এর ডাক দিলেন এবং বললেন- দুই পক্ষের সমঝেতার চুক্তিনামা সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে টম ল্যাবাঞ্চ বললেন, লিটল বাংলাদেশ এলাকায় আন্তর্জাতিক করিডোর করার কথা ভাবছেন তিনি এবং প্রতিটি ব্লকে এক একটি দেশের নামকরণ থাকবে। কারণ এই এলাকায় বিভিন্ন জাতির বা দেশের মানুষের বসবাস করে।

এ কথা আমরা কর্ণপাত করলাম না। প্রক্রিয়া চলছে পদ্ধতিগত নিয়মতান্ত্রিকভাবে। আমাদের আবেদনের উপর ভিত্তি করে ইসু্য সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, ইস্যুকে নিয়েই এগুতে হবে। 

চূড়ান্তভাবে মিটিং বসলো কাউন্সিলম্যানের অফিসে। এই সময় মুজিব সিদ্দিকী মিটিং-এ উপস্থিত হননি। তবে সিটি হলে একটি ইমেইল করেন এবং ইমেইলটি সকলের কাছে কপি পাঠান। যাতে লেখা ছিল যে, তিনি বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসেবে কোরিয়ান কমিউনিটির সাথে এমওইউ প্রণয়ণ করেছেন। তার ভিত্তিতে আলোচনার জন্য তিনি কমিউনিটির প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। জরুরী করণে তিনি উপস্থিত থাকতে পারছেন না।  

মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষরের জন্য উভয় কমিউনিটির প্রতিনিধি উপস্থিত হয়। মুজিব সিদ্দিকীকে না দেখে চ্যাংলি সীমারেখা নরমেন্ডী থেকে আলেকজেন্ডার পর্যন্ত দিতে রাজী হয়।  শেষমেষ আমও যাবে ছালাও যাবে, এমন পরিস্থিতিভেবে কমিউনিটির পক্ষে মোহাম্মদ শামীম হোসেন (যিনি প্রক্রিয়ার সূচনা সৃষ্টি করেছিলেন) মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর করেন এবং কোরিয়ান কমিউনিটির পক্ষে চ্যাংলি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে কোরিয়া টাউনের বুকের মধ্যে থার্ড স্ট্রীষ্টের উপর নিউ হ্যামস্যায়ার (ভরমেন্টের এক ব্লক পশ্চিমে) এবং আলেকজেন্ডার পর্যন্ত ঠিক লিটল আরর্মেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত থাইটাউনের মত জন্মনিল লিটল বাংলাদেশ। কাউন্সিলম্যান টম ল্যাবাঞ্জের অফিসে বসেই দুই কমিউনিটির স্বাক্ষর হয় ১৫ আগষ্ট ২০০৯ সালে। সিটি কতৃক উক্ত আবেদন অনুমোদন পায় ২১ আগষ্ট ২০১০ সালে। 

লিটল বাংলাদেশ এলাকায় মেয়র এরিক গ্যারসিটি কতৃক সাইন উন্মোচিত হয় ২৮ নভেম্বর ২০১০ সালে। এ উপলক্ষ্যে ১৫ জানুয়ারি ২০১১ তে কমিউনিটির কমিটি কর্তৃক প্রথম লিটল বাংলাদেশ উদযাপন হয় আলেকজেন্ডার রাস্তার উপর মঞ্চ তৈরি করে। 

লিটল বাংলাদেশ এত লিটল কেন হল তার জন্যে কমিটি এখনও পর্যন্ত ক্ষুব্ধ ভাবাপন্ন ও দোষারোপ করে মুজিব সিদ্দিকীর প্রতি , কারন তাদের ধারনা মুজিব সিদ্দিকী যদি একক চেষ্টায় কোরিয়ান কমিউনিটিদের সাথে গোপনে যদি চুক্তি করতে না যেত তা হলে আমরা আরও বেশী আদায় করতে সক্ষম হতাম। তাড়াহুডা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। অপর দিকে জনাব সিদ্দিকী বলেন, এভাবে না করলে কিছুই পাওয়া যেত না। আমি অবশ্য তার সাথে একমত নই, কারন আইন ছিল আমাদের পক্ষে, আমরা শক্তিতে দুর্বল হতে পারি কিন্তু আইনগত ডিপলমেসিতে আমরা জয়ী হতে পারতাম। ওনলি ম্যাটার অব টাইম। তড়িঘড়ি করে কোন কিছু করলে সাময়িক নাম কামান যায় মাত্র। 

লিটল বাংলাদেশ চুক্তিপত্র অনুযায়ী ওয়ান ওয়ান ফ্রি ওয়েতে নর্থ বাউন্ড এবং সাউথ বাউন্ডে দুটি এবং দুটি বের হওয়ার পথে দুটি ফ্রি ওয়ে সাইন বসানো হয় ১৪ মে ২০১৪ সালে। এই সাইন দেওয়ার ফলে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ লিটল বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের নাম স্মরণ করছে। এটাই কমিউনিটির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ফ্রি ওয়ে সাইন চার বছর পর হওয়ার কারণ হল, অর্থের জন্য সাইনবোর্ড উঠছিল না। ফ্রি ওয়ে সাইনের জন্য যে পদ্ধতি আছে তার জন্য অনুমোদন নিতে হয় ডিপার্টমেন্ট অব ট্র্যান্সপোর্টেশনের কাছ থেকে। তাদের ফি দিতে হয়, তারপর তারা পদ্ধতিগতভাবে অনুমোদন করে। এ ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল যে, উক্ত ডিপার্টমেন্টে প্রচুর বাংলাদেশী আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত। ইনজিনিয়ার জলিল খান সহ সালেহ কিবরিয়া ও আরও অনেকেই এব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন এবং অর্থ যোগাড়ের ব্যাপারে সোহেল রহমান বাদলে ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।   

‘লিটল বাংলাদেশ’ কমিউনিটির একটি মোদের গর্ব। নতুন প্রজন্মের ঠিকান।   ও মূলধারার সাথে কমিউনিটির একটি সেতুবন্ধন। 

যতদিন রবে লস এঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা , ততদিন রবে বিশ্বের বুকে, লিটল বাংলাদেশের নাম, যা দেশ ও জাতিকে আরও উচ্চে নিয়ে যাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম ।

লিটল বাংলাদেশ প্রচারে মিডিয়ার ভূমিকা :

‘লিটল বাংলাদেশ’ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই প্রচারে মিডিয়ার ভূমিকা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে শুরুর দিকে ডকুমেন্টরী ও সংবাদ পরিবেশনে আমার, জাহান হাসানের, সাথে কুদ্দুস খান ও সৈয়দ এম হোসেন বাবুর নাম সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য।

আমরা প্রতিটি ধাপে ধাপে  ভিডিও এবং সংবাদ কমিউনিটিতে তথা বিশ্ব সংবাদে প্রচার করেছি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ইউটিউব এবং ফেসবুক, অনলাইন মিডিয়াতে এখনও তা দৃশ্যমান। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে লিটল বাংলাদেশ হওয়ার পর ‘লিটল বাংলাদেশ’ নাম প্রচারে আমার এবং জাহান হাসানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমরা সংবাদে সব সময় লস এঞ্জেলেসের সাথে লিটল বাংলাদেশ উল্লেখ করি শুরু থেকে। যাতে সকলেই ব্যবহার করে। ফলে আজ বহিঃবিশ্বে লিটল বাংলাদেশের নাম জেনেছে এবং জানছে। এখন সবাই বলছে লিটল বাংলাদেশের নাম।

 লিটল বাংলাদেশ বলতে এখন লস এঞ্জেলেসকে বোঝায়। স্থানীয় মিডিয়ার কারণেই ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লিটল বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব। আমাদের ফেসবুকে পেজ রয়েছে, লিটল বাংলাদেশ কমিউনিটি এবং লিটল বাংলাদেশ, লস এঞ্জেলেস। আমাদের এই প্রচারণার সূত্র ধরে সকলেই এখন ব্যাবহার করছে ‘লিটল বাংলাদেশ’। 

এটাই এখন আমাদের ঠিকান। লিটল বাংলাদেশ কোন সীমারেখা নয়, প্রবাসে দেশের মানুষ। প্রবাসে বাংলাদেশীদের আবাসই লিটল বাংলাদেশ। এ’যেন এক প্রবাস বাংলা। 

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post টিআইবির প্রতিবেদনে সরকার ও ইসির আঁতে ঘা লেগেছে : রিজভী
Next post সব শ্রেণিপেশার মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
Close